বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষায় আর পিছিয়ে থাকতে চায় না সিলেট

  •    
  • ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:৪০

সুনামগঞ্জের সরকারি সতিশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজ মুহাম্মদ মাসহুদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বেড়েছে। এ ছাড়া সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক সবাই শিক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক। এই সম্মিলিতি প্রচেষ্টার ফসল এবারের এসএসসির ফল।’

সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা শেফালি মুণ্ডা এ বছর এসএসসি পাস করেছে। একই বাগান থেকে আরও তিনজন পাস করেছে মাধ্যমিকে।

শেফালি মুণ্ডার বাবা সজল মুণ্ডার ভীষণ উচ্ছ্বসিত। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আগে তো আমাদের মধ্যে কেউ তেমন পড়ালেখা করত না। বাগানে পড়ালেখার সুযোগও তেমন ছিল না। এখন পড়ালেখায় আগ্রহ বাড়ছে। খেয়ে না খেয়ে হলেও সবাই ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা যাতে চা-শ্রমিকের এই অভিশপ্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। বাগানের পাশে একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ায় সুযোগও বেড়েছে।’

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের পাথরশ্রমিক আজমত আলী। তার ছেলেও স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।

আজমত বলেন, ‘পড়ালেখার গুরুত্ব এখন আমরা বুঝতে পারছি। নিজেরা পড়ালেখা না করে জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি। বাচ্চাদের জীবনও যাতে নষ্ট না হয় তাই তাদের সাধ্যমতো পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করছি।’

শিক্ষায় দীর্ঘদিন ধরেই পিছিয়ে সিলেট। দেশের মধ্যে শিক্ষার হারেও সবচেয়ে তলানিতে অবস্থান এই বিভাগের। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলগুলোতেও সিলেটের অবস্থান থাকে পেছনের দিকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে এখানকার মানুষের। সরকারের পক্ষ থেকেও সিলেটের শিক্ষার হার বাড়াতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এতে মিলছে সাফল্যও।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এসএসসি) ফলাফলে সিলেট বোর্ডে ৯৬.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, গত এক দশকের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

প্রবাসমুখিতা, ভৌগোলিক সমস্যা, দারিদ্র্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংকটসহ নানা কারণে সিলেটের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কথা আলোচনায় আছে।

দেশের চা-বাগানগুলোরে বেশির ভাগ সিলেট অঞ্চলে। সামান্য মজুরিতে কাজ করেন চা-শ্রমিকরা। ফলে দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান সিলেটের প্রায় ৩ লাখ চা-শ্রমিকের। বাগান এলাকায় তেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। ফলে চা-শ্রমিকের সন্তানেরাও পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষায়।

পাথরশ্রমিকসহ বিভিন্ন দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যেও শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ ছিল কম।

বিভাগের বিশাল অঞ্চলজুড়ে হাওর। এর মধ্যে হাওরপ্রধান জেলা সুনামগঞ্জ। সেখানে দারিদ্র্যের আঘাত আছে। এসব এলাকার যোগাযোগব্যবস্থাও নাজুক। রয়েছে শিক্ষকের সংকট। এসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা আছে।

শিক্ষায় সিলেটের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হাসানুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিলেটের প্রবাসমুখিতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এখনো এখানকার বেশির ভাগ তরুণের প্রধান স্বপ্ন কোনো রকমে বিদেশে যাওয়া, বিশেষত ইংল্যান্ডে। ফলে লেখাপড়া শেষ না করেই অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আবার মেধাবীদের অনেকেও উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছে।

‘এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার অভাবও উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। দেশে চাকরির সংকট রয়েছে। উচ্চ শিক্ষা নিয়েও অনেকে চাকরি পাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘হাওর এলাকার যোগাযোগ সমস্যা, হাওর ও চা-বাগানবেষ্টিত এলাকার দারিদ্র্য এবং অনীহার কারণেও শিক্ষায় সিলেট পিছিয়ে আছে।

তবে মোড় যে ঘুরছে, সেটিও স্পষ্ট হচ্ছে। এসএসসিতে পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে হাওরপ্রধান জেলা সুনামগঞ্জ। জেলার প্রতি ১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৯৭.২৯ জন।

সুনামগঞ্জের সরকারি সতিশ চন্দ্র (এসসি) উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজ মুহাম্মদ মাসহুদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। হাওর এলাকার যোগাযোগব্যবস্থাও আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বেড়েছে। এ ছাড়া সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক সবাই শিক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক। এই সম্মিলিতি প্রচেষ্টার ফসল এবারের ফলাফল।’

দেশের বাইরে যাওয়ার জন্যও এখন পড়ালেখার প্রয়োজন উল্লেখ করে উচ্চ শিক্ষায় বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা আদনান আহমদ বলেন, ‘এখন আর আগের মতো যে কেউই বিদেশ যেতে পারছে না। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষিত ও দক্ষ লোকদের কদর বেশি। ফলে বিদেশ যাওয়ার জন্যও পড়ালেখায় আগ্রহ বেড়েছে।’

অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক শুধাংশু তালুকদার বলেন, ‘এখন সব অভিভাবকই চান তাদের সন্তানদের ভালো লেখাপড়া করাতে। যিনি দরিদ্র, নিজে পড়ালেখার সুযোগ পাননি, তিনিও তার সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে চান। নিজেদের সাধ্যমতো শিক্ষায় বিনিয়োগ করেন তারা। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বেড়েছে। এসব কারণে ধীরে ধীরে সিলেটের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।’

আট বছরে পরীক্ষার্থী বেড়ে দ্বিগুণ

শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেটের এই পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায় গত ৯ বছরের এসএসসির ফলাফল আর অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর তথ্যেও।

২০১৩ সালে এ বোর্ডে ৫৮ হাজার ৫০৬ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে ৮৮.৯৬ শতাংশ। আট বছরের ব্যবধানে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

২০১৪ সালে ৬৮ হাজার ৮৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ৮৯.২৩ শতাংশ।

২০১৫ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭২ হাজার ২৪ জন শিক্ষার্থী। পাস করে ৮১.৮২ শতাংশ।

২০১৬ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৮৪ হাজার ৪৪৮ জন। পাসের হার ছিল ৮৪.৭৭ শতাংশ।

২০১৭ সালে ৯৩ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে ৮০.২৬ শতাংশ।

২০১৮ সালে ১ লাখ ৮ হাজার ৯২৮ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাসের হার ছিল ৭০.৪২ শতাংশ।

২০১৯ সালে পরীক্ষায় বসে ১ লাখ ১৩ হাজার ১৭১ জন। পাসের হার ছিল ৭০.৮৩।

২০২০ সালে ১ লাখ ১৬ হাজার ১০৪ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে ৭৮.৭৯ শতাংশ।

আর এবার পরীক্ষায় অংশ নেয় ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৯৬.৭৮ শতংশ।

এই সময়ে সারা দেশেই পরীক্ষার্থী বেড়েছে। কিন্তু দ্বিগুণ হয়ে যায়নি।

কী বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা

সরকারের নানা উদ্যোগের কারণেও সিলেটে শিক্ষার চিত্রে পরিবর্তন আসছে বলে মনে করেন ভাষাসৈনিক ও সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক আব্দুল আজিজ।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা, ভৌগোলিক অবস্থান, পাহাড়, টিলা, হাওর, চা-বাগান পরিবেষ্টিত অঞ্চলে দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ছিল সিলেট। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বাড়ানোসহ সরকারের নানা উদ্যোগে এখন এসব সমস্যা ছাপিয়ে শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে সিলেট।’

একই মত সিলেট এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র চন্দেরও। এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘এখন উপজেলা পর্যায়ের অনেক কলেজেও অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। নতুন নতুন কলেজ হচ্ছে এবং তরুণদের মধ্যে লেখাপড়ার আগ্রহও বাড়ছে। আগামী ১০ বছর পর এসবের সুফল পাওয়া যাবে।’

পাসের হারকেই সবকিছু মানতে রাজি নন তারা

তবে পাসের হার বাড়া আর শিক্ষার অগ্রগতি এক নয় বলে মনে করেন সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির উদ্দিন আহমদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের চেয়ে শিক্ষার আগ্রহ বেড়েছে। অভিভবকরা সচেতন হয়েছেন। এগুলো যেমন সত্য, তেমনি পাসের হার বাড়ার সঙ্গে শিক্ষার অগ্রগতি মেলানো যাবে না। শিক্ষার মান বাড়ছে কি না তা এখনই বলা যাবে না। তার জন্য আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।’

শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য বছর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গণিত ও ইংরেজিতে ফেল করে। এবার এই দুই বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে পাসের হারে।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কান্তি পাল বলেন, ‘বেশির ভাগ শিক্ষার্থী থাকে মানবিক বিভাগে। এ বছর সে সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজার। এবার মানবিকে পাসের হার প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ফলাফলে।’

তবে এবারের পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গ মেধা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না বলে মনে করেন সিলেটের মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। এই শিক্ষাবিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবার যে সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে তা দিয়ে মেধা যাচাই করা সম্ভব নয়। তবে এটা সত্য, এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে। এখন শিক্ষার মান বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর