বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অতুলনীয় স্বাদ আর ঘ্রাণের হাজারী গুড়

  •    
  • ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:০৮

ঐতিহ্য, স্বাদ সব মিলিয়ে হাজারী গুড়ের চাহিদা থাকে বছরজুড়ে। তবে শীত মৌসুমে চাহিদা বাড়ে কয়েক গুণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই সময় হাজারী গুড় কিনতে মানিকগঞ্জে ভিড় করেন পাইকারি ক্রেতা থেকে সাধারণ মানুষ।

দেশে শীতকাল মানে যেন খেজুরের রস আর গুড় খাওয়ায় মহোৎসব। তবে কিছু গুড় স্বাদ আর ঘ্রাণে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মুগ্ধ করেছে বিশ্ববাসীকে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের বিখ্যাত হাজারী গুড় তেমনই একটি।

জনশ্রুতি আছে, এই গুড় খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের রানি প্রথম এলিজাবেথ। এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে সেই গুড়ের কারিগরকে উপহার দিয়েছিলেন হাজারী লেখা সিল।

ঐতিহ্য, স্বাদ সব মিলিয়ে হাজারী গুড়ের চাহিদা থাকে বছরজুড়ে। তবে শীত মৌসুমে চাহিদা বাড়ে কয়েক গুণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই সময় হাজারী গুড় কিনতে মানিকগঞ্জে ভিড় করেন পাইকারি ক্রেতা থেকে সাধারণ মানুষ।

বিখ্যাত গুড়টির শুরু নিয়ে অবশ্য যা জানা যায় পুরোটাই জনশ্রুতি। এ গুড় তৈরির বর্তমান প্রজন্মের কারিগর দেলোয়ার হাজারী জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে একদিন বিকেলে খেজুরগাছে হাঁড়ি পেতে নিচে নামেন তাদের পূর্ব পুরুষ মিনহাজ উদ্দিন হাজারী। ওই সময়ই এক দরবেশ তার কাছে রস খেতে চান।

নারীরা চুলায় বড় হাঁড়িতে রস জ্বাল দিতে শুরু করেন। ছবি: নিউজবাংলা

পরে ফের গাছে উঠে হাঁড়িতে জমা অল্প পরিমাণ রস দরবেশকে খেতে দেন তিনি। এতে খুশি হয়ে দরবেশ তাকে গুড়ের বিষয়ে আশীর্বাদ দিয়ে বলেন, মিনহাজের গুড়ের মতো গুড় পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। এই গুড়ের নাম বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। এরপর থেকেই তার গুড় সাদা, নরম, সুস্বাদু আর ঘ্রাণে ভরে যায়।

হাজারী গুড় নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি, এই গুড় খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রথম রানি এলিজাবেথ।

উপজেলার ঝিটকা গাছিপাড়ার রহিজ হাজারী বলেন, ‘প্রায় ২০০ বছর আগে রানি এলিজাবেথ এই গুড় খেয়েছিলেন এবং খুশি হয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষকে হাজারী লেখা একটি সিল উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা সপ্তম পুরুষ আগের মতোই সুস্বাদু গুড় তৈরি করে আসছি।’

এ গুড়ের কারিগররা জানান, রস সংগ্রহের জন্য ফজরের আজানের পরপরই বের হন গাছিরা। দূরদূরান্তের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতে আনেন তারা। রস পৌঁছানোর পর বাড়ির নারীরা চুলায় বড় হাঁড়িতে তা জ্বাল দিতে শুরু করেন।

দীর্ঘ সময় জ্বাল দেয়ার পর ঘন করে তা ঢালা হয় অন্য হাঁড়িতে। সেখানে কাঠের হাতল দিয়ে নেড়ে তৈরি করা হয় হাজারী গুড়। সব শেষে ছোট ছাঁচে ঢালার পর গুড়ের ওপর হাজারী সিল মারা হয়।

গুড় তৈরির পর সব হাঁড়ি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। ছবি: নিউজবাংলা

গৃহিণী সাহেদা বেগম জানান, ভোরে আজানের পরপরই ঘুম থেকে উঠে গাছিদের উঠিয়ে দেন তারা। গাছিরা রস আনতে গেলে তারা যান চুলা ও হাঁড়ি ঠিক করতে। রস আসার পর তা ছেঁকে হাঁড়িতে জ্বাল দেয়া শুরু করেন।

তিনি বলেন, ‘গুড় তৈরির পর আবার সব হাঁড়ি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করি। তা ছাড়া গাছের নাল পানিতে ফুটাতে হয়। গুড়ের সময়ে আমাগো ভোর থেকে সারা দিন কাজ করতে হয়। হাজারী গুড় তৈরি করতে খুব কষ্ট।’

ঝিটকা এলাকার গাছিপাড়ার সিদ্দিক গাছি জানান, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন এই চার মাস খেজুরের রস পাওয়া যায়। এই সময় গুড় তৈরির পর বাকি সময় কৃষিকাজ করেন। তবে সংসার চলে মূলত গুড়ের টাকায়।

তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আমাগো দিকে খেয়াল করে, তাইলে আমাগো উপকার হয়। বিশেষ করে যেন খেজুরগাছ লাগায় আর মানুষ যাতে খেজুরগাছ না কাটে তা দেখে।

মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি ঝিটকা গাছপাড়া এলাকার জামাই। বিয়ের পর প্রতি বছর শীতের সময়ে রস আর পিঠা খেতে শ্বশুরবাড়িতে আসি। কারণ এমন গুড় আর পাওয়া যায় না। খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমন তার ঘ্রাণ।’

হাজারী গুড় খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমন তার ঘ্রাণ। ছবি: নিউজবাংলা

গাছিদের কথায় অবশ্য উঠে এসেছে এ গুড়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা।

ঝিটকা এলাকার গাছিপাড়ার রমজান আলী গাছি বলেন, ‘আমাগো সব গাছির গাছ নাই, তাই মালিকের কাছ থেকে খেজুর গাছ লিজ নিতে হয়। এ বছর এক সিজনের জন্য গাছ কিনতে হয়েছে। গাছপ্রতি দাম পড়ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

‘এক কেজি গুড় তৈরি করতে ১২ কেজি রস লাগে। আর এক কেজি গুড় বিক্রি হয় মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকায়। সব খরচ বাদে তেমন কিছু থাকে না। এখন আগের মতো গাছও নাই, রসও হয় না। কিন্তু আমাগো খরচ তো প্রতি বছর বাড়তেছে।’

ঝিটকা গাছিপাড়ার রহিজ হাজারী বলেন, ‘আগে অনেক খেজুরগাছ ছিল। গুড়ও বেশি তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু দিনে দিনে খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে। এভাবে খেজুরগাছ কমতে থাকলে হয়তো একসময় হাজারী গুড় নাও থাকতে পারে।’

জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘লোকসংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর। এই স্লোগান সামনে রেখে হাজারী গুড়ের বিষয়টি প্রমোট করার চেষ্টা করছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খেজুরগাছ রক্ষা এবং খেজুরগাছ রোপণের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা হাজারী গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, কীভাবে এটিকে প্রমোট করা যায়। ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ব দরবারে কীভাবে প্রমোট করা যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর