মৃত্যুর সময়ে মস্তিষ্কে ঠিক কী ঘটে, সেটি জানার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এ গবেষণা খুব বেশিদূর এগোয়নি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মানুষের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ খুব একটা মেলে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রোগীকে জীবিত রাখার লড়াই চালাতেই চিকিৎসকেরা বেশি ব্যস্ত থাকেন।
ফলে মস্তিষ্ক মরে যাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষক বা বিজ্ঞানীদের যত গবেষণা, তা চলছে সাধারণ অন্য প্রাণীর ওপর। এর সঙ্গে যোগ করা হয় মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
তবে মানব মস্তিষ্কের ওপর একটি গবেষণা প্রমাণ করেছে, মৃত্যুর সময়ে সুনামির মতো ঘটনা ঘটে মগজে। এতে একের পর এক মস্তিষ্ক কোষের মৃত্যু ঘটে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, দেহে অক্সিজেনের জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ২০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে মস্তিষ্ক ‘এনার্জি সেভিং মোডে’ চলে যায়। মস্তিষ্কে তখন বৈদ্যুতিক সংকেতের প্রবাহ অচল হয়ে পড়ে ও নিউরনগুলো একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
এর কয়েক মিনিট পর কোষে আয়নের বিন্যাস এলোমেলো হয়ে মস্তিষ্কে ভাঙন শুরু হয়। একই সঙ্গে একটি ইলেকট্রোকেমিক্যাল শক্তির ঢেউ মস্তিষ্কের করটেক্সসহ অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঢেউকে স্প্রেডিং ডিপোলারাইজেশন বা ব্রেইন সুনামি বলছেন বিজ্ঞানীরা। আর এই সুনামির কারণে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয় মস্তিষ্কে।
জার্মানির ইউনিভার্সিটাট মেডিসিন বার্লিনের নিউরোলজিস্ট ইয়েন্স ড্রিয়েরের নেতৃত্বে এক দল বিজ্ঞানী মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত পাওয়া নয়জন রোগীর মধ্যে এ প্রক্রিয়াটি লক্ষ করেছেন।
তাদের মতে, ভবিষ্যতে এই ব্রেইন সুনামি থামানোর উপায় হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে অ্যানালস অফ নিউরোলজি জার্নালে।
ড্রিয়ের বলছেন, ‘(অক্সিজেন) প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ডিপোলারাইজেশন ঢেউয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চিত ইলেকট্রোকেমিক্যাল শক্তি কমতে থাকে এবং এর ফলে একটি বিষাক্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ কারণে শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটে।
‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি পর্যায় পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার গতি পরিবর্তন করা সম্ভব এবং এটি করা গেলে মস্তিষ্কের সক্রিয়তা আবার ফিরে আসবে।’
এই গবেষণায় সাবডুরাল ইলেকট্রোড স্ট্রিপ ও ইনট্রাপ্যারেনকাইমাল ইলেকট্রোড অ্যারেজের মতো স্নায়ু পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীদের মস্তিষ্কে ডিপোলারাইজেশন প্রক্রিয়াটি চিহ্নিত করা গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ থাকে, ততক্ষণ সুনামিটি একমুখী বিধ্বংসী ঢেউয়ের মতো আচরণ করে না।
এ-সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধে মস্তিষ্কের মৃত্যু ঠেকানোর সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এতে বলা হয়েছে, ‘অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে শুরু হওয়া ডিপোলারাইজেশনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ডিপোলারাইজেশনের সময় নিউরনগুলো ধ্বংস হওয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার শুরুর দিকটিকে বলা হয়, কমিটমেন্ট পয়েন্ট। এ সময় অক্সিডেটিভ সাবসট্রেট সরবরাহ পুনঃস্থাপন করা গেলে ব্রেন ডেথ সুনামি ঠেকানো সম্ভব।’
যেসব রোগী সেরেব্রাল ইসকিমিয়া (রক্ত প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস) বা অন্য কোনো ধরনের স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু বা মস্তিষ্কে ক্ষতির ঝুঁকিতে আছেন তাদের জীবন বাঁচাতে পারে এ গবেষণা।
তবে গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক কাজ করা এখনও বাকি।
ড্রিয়ের বলছেন, ‘রোগীদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে এই আবিষ্কারের কোনো প্রভাব নেই। চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য ডিপোলারাইজেশনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন জরুরি। আর সেটা সম্ভব হলে রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হওয়ার ফলে স্নায়ু কোষ ক্ষতির মাত্রা কমানো যাবে।’