স্কুল পড়ুয়াদের বকাঝকা, গালমন্দ না করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থাকতে শিক্ষক, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থাটা বুঝে সেভাবে পাঠদানের ব্যবস্থা নিতেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
অনেক সময় শিশুদের প্রতিবন্ধিতা আবিষ্কার করতে না পেরে উল্টো তাকে বকাঝকা করা হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে শিক্ষকদের আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, দুই লাখ শিক্ষককে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমি বলব না যে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রাখা লাগবে। সেটা রাখা যাবে না। সেটা সম্ভব না। কিন্তু প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত শিক্ষার্থীদের একটা পরীক্ষা নেয়া দরকার মানসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কার ভেতরে কী সমস্যাটা আছে।
‘শুধু ধমক দেয়া না, শুধু বকাঝকা না, তাদের অবস্থাটা বুঝে তাদের সঙ্গে সেইভাবে আচরণ করতে হবে। এটা বাবা, মা, গার্ডিয়ান, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’
আগে যৌথ পরিবার ছিল বলে শিশুরা সবার সঙ্গে হেসে-খেলে বড় হওয়ায় অনেক সমস্যা ঠিক হয়ে যেত বলে মনে করেন সরকারপ্রধান। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ভিন্ন বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন হয়ে গেছে সবাই একক পরিবার। একটা পরিবারে একটা বাচ্চা বা দুইটা বাচ্চা। বাবা-মা দুজন ব্যস্ত। বাচ্চাদের সময় দেয়া যাচ্ছে না। বাচ্চারা টেলিভিশন আর মোবাইল ফোন নিয়ে এখন সময় কাটায়, যাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে।’
গ্রামে এসব সংকট কম থাকলেও শহুরে জীবনে এসব প্রভাব বাড়ছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা চায় তাদের সাথি। বাবা-মাকেও সেই সাথি হতে হবে। তাদের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যটা ভালো হয়, উদার হয়, অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে শেখে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু পাঠ্যপুস্তক, একগাদা পড়ে যে শিক্ষা সে শিক্ষা না। শিক্ষাটা পরিবেশ সম্পর্কে, শিক্ষাটা মানসিকতা সম্পর্কে, শিক্ষাটা সবার সঙ্গে চলার। সেভাবে সবাইকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।’
কোনো কাজকে ছোট করে দেখা যাবে না বলেও জানান সরকারপ্রধান। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকের ছেলে যখন বড় অফিসার হয়ে যায়, তখন বাবাকে তার নামের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক, লজ্জাকর ব্যাপার। বরং সেই বাবাকে আরও বেশি সম্মান দেয়া উচিত, যে বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানকে বড় করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘নিজে দুই পাতা পড়ে, একটা ফুল প্যান্ট পরে আর মাঠে নামতে পারবে না, এই মানসিক দৈন্যতা বাংলাদেশের মানুষের থাকুক, সেটা আমরা দেখতে চাই না। এটা মানসিক দৈন্যতা, মানসিক দরিদ্রতা, অন্তত আমার কাছে।’
অনলাইন শিক্ষা চালু রাখতে হবে
আগের অভিজ্ঞতায় শীতের পর আবারও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে এমন শঙ্কা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘অনলাইনের শিক্ষাটা, এটা আমাদের চালু রাখতেই হবে। কারণ করোনা কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, শীতের পর পর প্রাদুর্ভাবটা আবার বেড়ে যায়। কাজেই এখন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সেই প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়, যেহেতু স্কুলগুলো চালু রাখা সম্ভব হবে না, যে কারণে অনলাইনের শিক্ষাটা প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থাটা নিতে হবে।’
দেশে এখন বিদ্যুতের সংকট নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনাটা অনলাইনে চালাতে পারে তার জন্য যে সমস্ত উপকরণ, যা যা লাগে সব ব্যবস্থা আমরা করব। কাজেই ঘরে বসে যেন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে, মোবাইলের মাধ্যমে বা ল্যাপটপের মাধ্যমে, টেলিভিশনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালু রাখতে পারে সেই পদক্ষেপটা নিতে হবে। সংসদ টিভি সবসময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবহার করতে পারবে। তার জন্য কোনো সমস্যা হবে না।’
করোনা প্রতিরোধী টিকার বাইরে কেউ থাকবে না
১২ বছরের ঊর্ধ্বে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শিক্ষকদের শুরুতে দেয়া হলেও এখন শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১২ বছর বয়স পর্যন্ত যারা তাদের সবাইকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকের একটু অনীহা দেখা দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, আমাদের যে কমিউনিটি ক্লিনিক সেন্টারগুলো আছে বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো আছে সারা বাংলাদেশে, তার মাধ্যমে টিকাদান কর্মূসচিটা যেন চালু রেখে, সেটা যেন অব্যাহত থাকে।’
প্রান্তিক মানুষেরাও যাতে টিকা বঞ্চিত না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘যাতে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, গ্রাম পর্যায়ের মানুষ যেন দ্রুত টিকা নিতে পারে। কারণ, নতুনভাবে যেন আবার সংক্রমিত না হয়, তার ব্যবস্থা এখন থেকে আমাদের নিতে হবে। কাজেই কেউ যেন টিকার বাইরে না থাকে। সবাইকে কিন্তু ভ্যাকসিন নিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি মনে করি আজকের যে দিনটা এদিনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে। এ কারণেই প্রতি বছর আমরা যেমন পরীক্ষার ফল ঘোষণা ও বই উৎসব করে থাকি, করোনার কারণে সেই উৎসব করা হয়নি। কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। এটা শুধু বাংলাদেশে না, বিশ্বব্যাপী এই সমস্যাটা দেখা দেয়। সমগ্র বিশ্বের এই করোনার জন্য সব কিছু স্থবির হয়ে যায়।’
স্থবিরতার মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে আসায় ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনে যে বই বিতরণ করতে পারছি বা পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে পারছি, যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব, নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম ২০০৮ সালে, আজকে বাংলাদেশ ডিজিটাল।
‘করোনার কারণে আমি খুব বেশি কোথাও যেতে পারি না। কিন্তু অনলাইনে মানে ডিজিটাল বাংলাদেশ যে করেছি, তার জন্য এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছি। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে রেজাল্ট দেয়া বা বই ছাপানো এবং বই বিতরণ করা এটা একটা কঠিন ব্যাপার।’
করোনাভাইরাসের কারণে এবারও বই উৎসব করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বই সবার হাতে যেন পৌঁছে যায়, সেই ব্যবস্থাটা নেয়া হয়েছে, প্রতিটা স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে যেন বই পৌঁছে যায়।’
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে বই তৈরি করে তা বিতরণ করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী, আমাদের যে ছোটো ছোটো নৃ গোষ্ঠী আছে, তাদের নিজস্ব একটি ভাষা আছে। অন্তত পাঁচটি নৃ গোষ্ঠীর ভাষার সন্ধান আমরা পেয়েছি। তাদের বই প্রস্তুত করে আমরা তাদের হাতে দিচ্ছি। যেন তারা মাতৃভাষা ভুলে না যায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পহেলা জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে। সেটা উদ্বোধন করলাম। কিন্তু ৪ তারিখ সমস্ত বই পৌঁছে যাবে সবার হাতে।’
এসএসসি উত্তীর্ণ সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘যারা কৃতকার্য হতে পারেনি, আমি জানি করোনার কারণে পড়ালেখার তেমন সুযোগ ছিল না বলে অনেকের সমস্যা হয়েছে। আমি অনুরোধ করব, আবার ভালোভাবে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।
‘আমরা একটা ব্যবস্থা করেছিলাম যদি কোনো একটা সাবজেক্টে ফেল করে শুধু মাত্র সেই সাবজেক্টটাই দিতে হবে, তার অন্য কারিকুলাম চলতে থাকবে। অর্থ্যাৎ তার প্রমোশনের কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু যে সাবজেক্টে সে ফেল করবে পরের বার সেই পরীক্ষা দিয়ে তাকে পাশ করতে হবে। যদি সে না পারে তাহলে ফেল ধরা হবে।’
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব, আপনারাও তাদের সহযোগিতা করবেন।’
‘অভিভাবক শুধু অভিভাবক না, তাদের শিক্ষকের ভূমিকাও নিতে হবে, দায়িত্বটা পালন করতে হবে।’