এক কর্মস্থলেই বছরের পর বছর অবস্থান, সনদ যাছাই-বাছাই ছাড়াই চাকরিতে নিয়োগ, ঋণ প্রদান এবং আদায়ের ক্ষেত্রে উদাসীনতাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।
ব্যাংকটির ওপর সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব মন্তব্য করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক আইন অনুযায়ী, একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি থাকাটা আইনের লঙ্ঘন। অথচ রাকাবে এক কর্মস্থলেই ১২ বছর ধরেও অবস্থান করছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
আবার চাকরির ক্ষেত্রে সনদ যাচাই করা বাধ্যতামূলক হলেও কোনো প্রকার ভেরিফায়েড এবং যাচাই বাছাই ছাড়াই হয়ে গেছে চাকরি। ব্যক্তিগত নানান বিষয়েও মিথ্যা তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশেষ অঞ্চলের কৃষি এবং কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষায় ১৯৮৭ সালে বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সরকার। তবে, কৃষকের উপকার তো দূরের কথা; নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে এখন পর্যদুস্ত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।
ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন না করা, ঋণের অর্থ উত্তোলন না করতে পারা এবং প্রশাসনিক সুশাসন না থাকায় ভেঙে পড়েছে ব্যাংকির সার্বিক কার্যক্রম। ফলে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থের যোগান দিচ্ছে সরকার।
কী আছে পরিদর্শন প্রতিবেদনে
রাকাবের কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে ব্যাংকটি পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম। পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত রাকাব-এর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবেদন জমা দেয়।
এই প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে নিউজবাংলার হাতে। তাতে রাকাবের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকসহ শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের এক শাখায় থাকার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩ বছর।
তবে, বছরের পর বছর এই নিয়মকে তোয়াক্কা করছেন না ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তা। কেউ কেউ একই শাখায় অবস্থান করছেন ১২ বছর ধরে। শুধু এক কর্মস্থলেই নয়, চাকরি দেবার ক্ষেত্রেও ঘটেছে বড় অনিয়ম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারেনি রাকাব। অর্থের বিনিময়ে হয়েছে নিয়োগ। ফলে অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকায় প্রতিবছরই নিম্নমুখী হচ্ছে মান।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, নিয়োগ করা কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র যাচাই বাছাই করা হয়নি। ফলে জাল সনদে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ প্রাপ্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বলা হয়, অনলাইনে শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে এসএসসি বা সমমান ও দাখিল বা সমমান পরীক্ষার ফলাফল ভেরিফাই বা যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে রাকাব কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ জাতীয় যাচাই বাছাই করা হয়নি।
মো. লুৎফর রহমান নামে সহকারী মহা ব্যবস্থাপকের ব্যক্তিগত নথিতে মিথ্যা তথ্যের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শন টিম। ১৯৮৪ সালের ৩ অক্টোবর দেয়া নথিতে এই কর্মকর্তা বলেন, তার স্থায়ী ঠিকানা নওগাঁ। চিঠিপত্রসহ নানা কাজে নওগাঁ ব্যবহার হয়ে আসলেও বর্তমানে তিনি বর্তমান ঠিকানা ‘ঢাকা’ উল্লেখ করছেন। বর্তমান কর্মস্থল ঢাকা করপোরেট শাখা হলেও তিনি স্থায়ী ঠিকানা লিখছেন, ‘থানা-ধানমন্ডি, জেলা-ঢাকা’। এমন অসঙ্গতি রয়েছে আরও।
ব্যাংকের অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে মামলাও হয়েছে বেশ কয়েকটি। ২০১৯ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল সাতটি। তারপর ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ১২টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচটি। আর অবশিষ্ট মামলার সংখ্যা সাতটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে, অধিকাংশ মামলাই হয়েছে ব্যাংকের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ঋণ প্রদান, ঋণের আদায় করা টাকা আত্নসাৎ, প্রতারণা, ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকার বিষয়ে।
প্রতিবেদনে আর বলা হয়, দুজন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের পরও আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তারা হলেন, লালমনিরহাট জোনাল কার্যালয়ের মূখ্য কর্মকর্তা আরিফ হোসেন মন্ডল এবং নওগাঁ মেছের বাজার শাখার কর্মকর্তা সাজ্জাদ উল বারী। তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া ঋণ প্রদান, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ার পরও চাকরিতে পুনরায় বহাল করা হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে রাকাবের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইসমাইল হোসেনকে (বর্তমানে কৃষি ব্যাংকের এমডি) একাধিবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে এসএমএস দেয়া হলেও কোনো জবাব দেননি।
ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা
রাকাবের আর্থিক অবস্থাও বেশ নাজুক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে রাকাবের দেয়া ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। ঋণ নিয়েছেন মোট ৮ লাখ ৭ হাজার ৭২০ গ্রাহক।
ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ৫ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। আমানতকারীর সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৫।
রাকাবের অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ৮২৪ কোটি টাকা। ১৮টি জোনাল কার্যালয়, আড়াই হাজার কর্মকর্তা ও ১ হাজার ২৯৩ জন কর্মচারী এবং ৩৮৩টি শাখা নিয়ে চলছে এই ব্যাংকের কার্যক্রম। মোট শাখার মধ্যে ৩৩৩টি গ্রামে অবস্থিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংকেই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চলছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো সরকার মুলধন সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা কোনো সমাধান নয়।
‘এখানে প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে যুক্ত। এসবের কোনো বিচার হয় না। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত এবং পর্ষদকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে। এজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
রাকাব যে মডেলে চলছে এটা টেকসই নয় বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। নিয়মকানুন ভেঙে ঋণ দেয়া হচ্ছে। ঋণের অধিকাংশ টাকাই খেলাপি। আবার অর্থ আদায়ে আইনি কাঠামোও বেশ দুর্বল। নিয়োগেও রয়েছে অনিয়ম। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আলোচনা করে দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’