বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাথানের সেই দিন আর নেই

  •    
  • ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:১৮

গত দুই দশকে হাকালুকিতে কমেছে অর্ধেকেরও বেশি বাথান। হাওর অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমের ঐতিহ্যবাহী কর্মকাণ্ড তার সুদিন হারিয়ে ফেলছে। গো-খাদ্য সংকট আর চোরের উপদ্রবে বাথান ব্যবসা লাভজনক থাকছে না।

ছোট-বড় ২৩৮টি বিল, ১০টি নদী নিয়ে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের দেশের বড় হাওর হাকালুকি। বর্ষায় নদী-খাল প্লাবিত হয়ে এই হাওর ২৩ হাজার হেক্টরের বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়। শুকনা মৌসুমে যেন মরুভূমি। তখন শুরু হয় এর অন্যতম ঐতিহ্য ‘বাথান’ (গবাদিপশুর রাখালি) ব্যবসা।

কিছুদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা থেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন এ পেশায় জড়িতরা। গো-খাদ্য সংকট, বাথানে পর্যাপ্ত গবাদিপশু না পাওয়া, চোরের উপদ্রব এবং সংগৃহীত দুধ বাজারজাত করার সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতায় একসময়ের পুঁজিহীন লাভজনক এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। গত দুই দশকে হাকালুকিতে কমেছে অর্ধেকেরও বেশি বাথান।

হাকালুকি এলাকা ঘুরে জানা যায়, প্রতিবছর শুকনা মৌসুমে হাকালুকি তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকার গৃহস্থ তাদের গবাদি পশুর খাবার নিয়ে সংকটে পড়েন। হাওরে গো-খাদ্যের উর্বর ভূমি থাকায় সেখানকার খোলা প্রান্তরে গরু-মহিষ পাঠিয়ে দেন মালিকরা। এ জন্য বাথান থেকে গবাদিপশু ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এগুলোর মালিকরা খুশি হয়ে পাঁচ শ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত দেন।

আর দুধেল গাভীর জন্য মালিকদের টাকা দিতে হয় না। প্রতিটি ছোট বাথানে ২০০ থেকে ৪০০ এবং বড় বাথানে ৫০০ থেকে ৮০০ গরু-মহিষ রাখা হয়। অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত বাথানে থাকা গরু-মহিষ থেকে দুধ ও গোবর সংগ্রহ করে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। ছোট বাথানে ৭-৮ জন, বড় বাথানে ১০ থেকে ১২ জন লোক মাসিক পারিশ্রমিকে কাজ করেন।

প্রতিদিন সকালে বাথানের কাজে নিয়োজিত রাখালরা গাভী থেকে দুধ দোয়ানোর পর গরু-মহিষ সারা দিন বিস্তীর্ণ হাওরে চড়ে বেড়ায়। সন্ধ্যা হলে আবার নির্দিষ্ট স্থানে এনে গবাদি পশুগুলো বেঁধে রাখেন। হাওরে রাত কাটানো কষ্টকর হলেও সেখানে তাঁবু টাঙিয়ে থাকেন। এতে এই মৌসুমে বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

প্রতিটি বাথানে থাকা গাভী থেকে দৈনিক ৭০-৮০ লিটার থেকে দেড় শ লিটার পর্যন্ত সংগৃহীত দুধ আশপাশের এলাকার চাহিদা মিটিয়ে ছানা তৈরির জন্য বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয়। এভাবেই হাওরের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় এ ব্যবসা চলে আসছিল যুগের পর যুগ, সম্প্রতি যাতে ভাটার টান লেগেছে।

হাওরে বেড়েছে চোরের উপদ্রব। বাথানে প্রয়োজনীয় গবাদিপশুও আর আসছে না। যে দুধ সংগ্রহ করা হয়, তা বাজারজাত করতে সমস্যা হয়। ‘বাথান’ ব্যবসায় সেই রমরমা নেই। এ পেশায় জড়িতরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বাথানের সঙ্গে জড়িতরা। ছবি: নিউজবাংলা

হাওরের কালাপানি, ফুটবিল, টেকুনা, চকিয়া, নাগুয়া বিল এলাকায় ১৫টির বেশি ছোট-বড় বাথান রয়েছে।

বাথানের গবাদিপশু চরানোয় ব্যস্ত শ্রমিক (রাখাল) কয়েছ মিয়া, তানভীর, মাজিদ আলী, ছমর মিয়ার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বর্ষাকালে কেউ নৌকায় বালু-ইট পরিবহন, কেউ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত শুধু বিল ছাড়া হাওরে পানি থাকে না। তখন রোজগারের জন্য বাথানের গরু-মহিষ হাওরে চরানো, পরিচর্যা, দুধ দোয়ানো ও রাতে পাহারা দিতে হয়। এ জন্য তারা কাজ অনুযায়ী মাসে কেউ ১০ হাজার টাকা, কেউ ৬ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পান।

তারা বলেন, বিল ও জলাশয়ের তীরে প্রচুর ঘাস থাকে। কিন্তু বিলের ইজারাদারদের ও ক্ষেতের মালিকদের নিষেধের কারণে হাওরে আগের মতো গরু-মহিষ চরানো যায় না। এ ছাড়া বিল ও জলাশয়ের পাশে পাখি শিকারিদের ফেলে রাখা বিষটোপের কারণে গরু-মহিষ চরিয়ে ঘাস খাওয়ানো যায় না, ঘাস কেটে এনে খাওয়াতে হয়। এটি কষ্টসাধ্য।

কালাপানি, টেকুনা ও নাগুয়া বিল এলাকায় থাকা বাথানের মালিক অশোক মিয়া, হীরা মিয়া, লয়েছ আহমদ ও তুহিন আলী জানান, কুলাউড়া জুড়ীর বিভিন্ন গ্রামের লোকজন তাদের গরু-মহিষ বাথানে দিয়ে যান। গত ৭-৮ বছর ধরে বাথানের সংখ্যা কমেছে। গরু-মহিষের সংখ্যাও কমেছে অনেক।

আগে হাওরের কুলাউড়া ও জুড়ী অংশে ৬০-৭০টি বাথান ছিল। আগে একেকটি বাথানের জন্য ৩০০ থেকে ৭০০ গরু-মহিষ পাওয়া যেত। প্রতিদিন ৬০-৭০ লিটার থেকে ১০০ লিটারের বেশি দুধ সংগ্রহ করা যেত।

এখন বড় একেকটি বাথানে খুব বেশি হলে ৩০০ থেকে ৪০০ গরু-মহিষ আছে। দিনে বড়জোর ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

বর্তমানে বাথান থেকে দিনে বড়জোর ২৫ থেকে ৩০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। ছবি: নিউজবাংলা

বাথান মালিকরা জানান, অনেক বাথানে ৫-৬ জন মিলে গরু-মহিষ এনে নিজেরাই দেখাশোনা করতেন। আবার কেউ কেউ বেতন দিয়ে ৭-৮ জন লোক রেখে বাথানের গরু-মহিষ দেখাশোনা করতেন। বছরের ৫ থেকে ৬ মাস এ ব্যবসায় ভালোই লাভ হতো।

হাওরে এখন খরা বেড়েছে। যখন-তখন বজ্রবৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে থাকা গরু-মহিষ অসুস্থ হয়ে যায়। তখন চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বাথান কমে যাওয়ায় রাতে চোরের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। এতে মালিকরা তাদের গরু-মহিষ আর বাথানে দিতে চান না। আগে একটি বাথানে ৫-৬ জন রাখাল কাজ করতেন, কিন্তু এখন গরু-মহিষ কমে যাওয়ায় ৩-৪ জনের বেতন চালানো অনেক কষ্টসাধ্য। তাই অনেকে বাথান ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় কর্মকর্তার ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে থাকা ডা. গোলাম মোহাম্মদ মেহেদী বলেন, ‘আগে হাওর ও আশপাশের এলাকায় গবাদিপশু অসুস্থ হলে ভেটেরিনারি রায়হান আহমদ চিকিৎসা দিতেন। উনি মারা যাওয়ার পর থেকে পদটি শূন্য। লোকবল সংকট ও যাতায়াত কষ্টসাধ্য হওয়ায় যখন-তখন হাওরে গিয়ে বাথানের অসুস্থ গবাদিপশুর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। তবু আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

‘হাওরে গো-খাদ্য সংকট, যেখানে-সেখানে শিকারিদের ফেলে রাখা বিষটোপ খেয়ে ও শেড (ছাউনি) ছাড়া খোলা আকাশের নিচে থাকায় গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে যায়। অনেক মালিক এখন আর তাদের গরু-মহিষ বাথানে দিতে চান না। এ জন্য হয়তো বাথানের আগ্রহ কমে যাচ্ছে অনেকের।’

এ বিভাগের আরো খবর