দেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার যে মহাসড়কে উঠে এসেছে, এর অন্যতম কৃতিত্ব ব্যাংক খাতের। স্বাধীনতার পর ব্যাংকের অর্থায়নে দেশে গড়ে উঠেছে বিশাল উদ্যোক্তা শ্রেণি, যাদের হাত ধরে বিস্তৃত হয়েছে বেসরকারি খাত।
রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বুধবার ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন-২০২১’-এ বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। সম্মেলনের এবারের বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
‘পাঁচ দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ শিরোনামে সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সম্মানিত অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সালেহউদ্দিন আহমেদ, আতিউর রহমান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও মাসরুর আরেফিন স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্মেলনের আয়োজক দৈনিক বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রদর্শনীতে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গভর্নরদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও অর্জন তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন পর্যন্ত ১১ জন গভর্নর এসেছেন।
মূল প্রবন্ধে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ৪১তম বড় অর্থনীতির দেশ। ২০৩৫ সালে শীর্ষ ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। সামনের দিনে দেশের অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোভিড পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন একটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
এক ভিডিওবার্তায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, করোনার কারণে যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে এর ৮০ শতাংশই পেয়েছে বড় উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেভাবে প্রণোদনার অর্থ পাননি। বিষয়টিকে নিয়ে আরও ভাবার আহ্বান জানান তিনি।
মানি লন্ডারিং ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর ভূমিকা পালনের ওপর জোর দেন সাবেক এই গভর্নর। বলেন, অর্থিক দুর্নীতি বা যেকোনো তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে গেলে দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হয়।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে ব্যাংক খাত। এ জন্য অর্থনীতি এখনও টিকে আছে। মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও বড় ভূমিকা রেখেছে। করোনার মধ্যে এ সেবার মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে সব কাজ করতে পেরেছে।
আতিউর রহমান বলেন, ‘দুই বছর পর বেসরকারি ঋণ ১০ অঙ্ক পার করেছে। তার মানে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও কৃষি এ তিন খাত মহামারিতে আমাদের রক্ষা করেছে। তবে এ তিন খাতের মধ্যে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। এ জন্য রেমিট্যান্সে ২ শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া উচিত।’
টেকসই অর্থনীতি বাস্তবায়নে আটটি সুপারিশ করেন আতিউর। তিনি বলেন, ‘করোনার ফলে আমাদের আমদানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। আশার কথা হলো, এর বেশির ভাগই কাঁচামাল। ফলে এটা শিল্পের জন্য সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
‘আমাদের প্রবাসী বন্ড কেনায় এক কোটি টাকার যে লিমিট আছে, সেটা উঠিয়ে বাড়ানো যেতে পারে। বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনে এর সুদহার ১০ শতাংশের স্থানে ৮ শতাংশ করা যেতে পারে। আগামীতে ট্রিলিয়ন ডলারের দেশ হবে বাংলাদেশ। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকে যদি না হারাতাম তাহলে আজকের অবস্থায় অনেক আগেই যেতে পারতাম।’
অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। বিশ্বের শীর্ষ ৪১টি শীর্ষ অর্থনীতি দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল গত অর্থবছরে। তার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ যোগসূত্র থাকার কারণে।
রউফ তালুকদার জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো ফাইন্যান্স ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদান হলো অটোমেশন।
তিনি বলেন, একসময় সরকারিভাবে ১০০ টাকা বিতরণ করতে গেলে ২৫ টাকা খরচ করতে হতো। এখন তা হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিটি গভর্নর উপযুক্ত। ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলো অর্থনীতির মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ডও বলা যায়। দেশে এত উন্নয়নের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাত। দেশের আর্থিক খাতে অনেক সংস্কার হয়েছে।
তবে আর্থিক খাতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে জানান ওয়াহিদউদ্দিন। তিনি বলেন, মুক্ত অর্থনীতিতে যে কেউ শেয়ার কিনে ব্যাংকের মালিক হতে পারছে। একই পরিবারের কাছে যেকোনো ব্যাংকের ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। এটার সংশোধন দরকার। সেটা এখনও হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লাগাম ছেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংক টাকা ফেরত পাচ্ছে না, ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বড় বড় উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। তবে কেউ ঋণ নিয়ে ফেরত দেবেন না এ উদ্দেশ্যে ব্যবসা করেন না। সমস্যার কারণে হয়তো তারা দিতে পারেন না। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরও বিবেচনা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবসায়ী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।