প্রায় এক দশক আগে অবসর নেয়ার পর নিজের বাড়িতেই ছিলেন প্রিয় শিক্ষক। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার অসুস্থও হয়েছেন। আর্থিক দুরবস্থায় দিন কাটছিল তার। তবে শিক্ষকের কথা ভুলে যাননি সাবেক শিক্ষার্থীরা। প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকেই তারা প্রিয় শিক্ষকের থাকার জন্য তৈরি করে দিয়েছেন আরামদায়ক ঘর।
মাওলানা শাহ আলম পড়াতেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা গ্রামে ড. শহিদুল্লাহ একাডেমিতে।
২০১২ সালে অবসর নেয়ার পর নিজের এলাকা বাঁশখালী উপজেলার শিলকূপে চলে যান তিনি।
শিক্ষকতা জীবনে বিদ্যালয় থেকে নিজের বাড়ি দূরে হওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষার্থীর বাসায় গৃহশিক্ষক হিসেবে থাকতেন। ইসলাম ধর্মের এই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘হুজুর স্যার’ নামে।
মা, বাবা, ভাই-বোন নিয়ে যৌথ পরিবার। পুরো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। সম্মানি হিসেবে যা পেতেন, তা দিয়েই টেনেটুনে চলতো সংসার।
১৯৬০ সালে গ্রামে একটি মাটির ঘর তৈরি করেছিলেন তার বাবা। সেই ঘরেই বসবাস করতেন পরিবারের সবাই। শিক্ষকতা জীবনের উপার্জন দিয়ে পরিবার চালাতে গিয়ে ঘর মেরামতের সুযোগ পাননি তিনি।
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জীর্ণশীর্ণ হয়ে যায় সেই মাটির ঘর। ৩৩ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসর গ্রহণের পর সেখানেই ফিরে যান শাহ আলম।
অবসর নেয়ার পর ২০১২ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এই শিক্ষক। খবর পেয়ে সাবেক শিক্ষার্থীদের কয়েকজন তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেন। এসময় শিক্ষকের জীর্ণ বাড়ি দেখে কষ্ট পান তারা।
পরে ফেসবুকে একটি গ্রুপে সবাই একত্রিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ করে শিক্ষকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোজাফফর আহমেদ। তিনি ওই বিদ্যালয়ের এসএসসি-১৯৯৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
পরে ২০২১ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হন শিক্ষক শাহ আলম।
সর্বশেষ চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্ট্রোক করলে সাবেক শিক্ষার্থী নাসির, এরশাদ ও ফারুকের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোজাফফর আবারও প্রবাসী মনির, রাশেদসহ সব সাবেক শিক্ষার্থীকে নিয়ে অর্থ সংগ্রহে নামেন।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে শিক্ষকের বাসায় যান দেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা।
সাবেক শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে মাওলানা শাহ আলমের বাড়িতে তৈরি হওয়া নতুন ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
এবার গিয়ে দেখা যায়, পুরনো জীর্ণ ঘরটি আরও জীর্ণ হয়ে গেছে। ততদিন প্রায় ৭০ বছর বয়সী ওই শিক্ষক বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না, কথাও অস্পষ্ট।
সাবেক শিক্ষার্থীদের একজন বেলাল তালুকদার বলেন, ‘আমরা গিয়ে দেখি পুরনো জীর্ণ ঘরটি আরও জীর্ণ হয়ে গেছে। ভয়াবহ অবস্থা, মানুষ থাকার মতো না। তবে স্যার একটু সুস্থ হয়েছেন। স্যারের ঘর দেখে আমাদের মনে হয়েছে এই ঘরে থাকলে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
‘তাই সবার পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগৃহীত টাকা থেকে স্যারকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা আমরা জমা রাখি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই স্যারকে এক বেডের একটি বাড়ি করে দেয়ার, যেন অন্তত তিনি আরামে থাকতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ১৯৯৩ ব্যাচের শহীদ চৌধুরী নামের একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি তখনই অ্যাটাচড বাথরুমসহ এক বেডের একটি বাড়ির ড্রয়িং করে স্থানীয় একজন রাজমিস্ত্রি ডেকে বুঝিয়ে দেন। বিষয়টি প্রবাসী মোজাফফরকে জানালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করেন।’
বেলাল তালুকদার বলেন, ‘পরে আরও বেশ কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী জানান- স্যারের বাড়ি বানানোর জন্য যত টাকা লাগে তারা দিতে প্রস্তুত। এতে মাত্র সাত দিনে ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ দেশ-বিদেশের প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়।’
ফারুক সিকদার নামে আরেক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হাটহাজারী থেকে স্যারের বাড়ির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের বেশি হলেও স্যারের প্রতি ভালোবাসার কাছে সেটি কিছুই না। স্যারের জন্য বাড়ি তৈরির শুরুতে আমরা স্থানীয় বাজার থেকে প্রয়োজনীয় রসদ কিনে কাজের উদ্বোধন করে আসি। পরে বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্যান, লাইট, ভেন্টিলেটর, পানি তোলার মোটরসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে বাড়িটি সাজানো হয়।’
বাড়িটির নকশা করেছেন সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী শহীদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘স্যারের পুরনো বাড়িটি ছিল দুই অংশে। একটা মূল বাড়ি, মাঝে কিছু জায়গা খালি, তারপর একটা কাচারি ঘর। আমরা মাঝের খালি জায়গাতেই স্যারের জন্য বাড়িটি তৈরি করেছি। পুরনো বাড়িটি আগের মতোই আছে৷
‘অনেকে বলছেন, আমরা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করে দিয়েছি। এটা আসলে ভুল তথ্য। পুরনো বাড়ি আগের জায়গাতেই আছে৷ স্যারের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় আগের বাড়িটি রেখে দিয়েছি আমরা। ২৪ ডিসেম্বর আমরা স্যারকে বাড়িটি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি।’