নারীর মস্তিষ্কের যে অংশটি তার যৌনাঙ্গে স্পর্শের অনুভূতিকে বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সেটি চিহ্নিত করার দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এর ফলে ভবিষ্যতে যৌন সহিংসতার শিকার বা যৌনতায় নিরাসক্ত নারীদের চিকিৎসায় নতুন পথ খুলবে।
নিউরোকিওর ক্লাস্টার অফ এক্সিলেন্সের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণার ফলটি চলতি মাসে দ্য জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
জীববিজ্ঞানী, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট ও নিউরোলজির গবেষকদের একই দল এই গবেষণা চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল, নারীর মস্তিষ্কে যৌনাঙ্গের উদ্দীপনার প্রভাব এবং এটি কম-বেশি করা সম্ভব কি না তা যাচাই করা।
এই গবেষণাটি করা হয়েছে ১৮ থেকে ৪৫ বছরের ২০ নারীর ওপর। এরা সবাই মানসিক, স্নায়বিক বা যৌনব্যাধি মুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, নারীর যৌনাঙ্গে স্পর্শের পর মস্তিষ্কের সোমাটোসেনসরি করটেক্স উদ্দীপনা গ্রহণ ও সেটি প্রক্রিয়াজাত করে থাকে।
উদ্দীপনা গ্রহণকারী সোমাটোসেনসরি করটেক্সের সুনির্দিষ্ট অংশটির আকার বা পুরুত্ব বিভিন্ন নারীর ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। উদ্দীপনার মাত্রার ওপরেও এই পরিবর্তন নির্ভরশীল। গবেষণায় অংশ নেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে যৌনতায় বেশি জড়িতদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ওই অংশটি বেশি বিকশিত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, এতদিন পর্যন্ত নারীর যৌনাঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের করটেক্সের কোন অংশটি যুক্ত- তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। এর বড় কারণ হলো, যৌনতার ক্ষেত্রে শরীরের অন্যান্য অংশও স্পর্শ করা হয় এবং এতেও যৌন আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে কেবল যৌনাঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের সরাসরি যুক্ত অংশ চিহ্নিত করা বেশ জটিল ছিল।
পুরুষের ক্ষেত্রে অবশ্য মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট অংশটি চিহ্নিত করা গেছে প্রায় দেড় যুগ আগে। ২০০৫ সালে গবেষকেরা এমন একটি কৌশল বের করেন যা পুরুষের যৌনাঙ্গে স্থানীয়ভাবে স্পর্শকাতর উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে তারা পুরুষের লিঙ্গের জন্য মস্তিষ্কে সুনির্দিষ্ট অঞ্চল খুঁজে পেতে সক্ষম হন। তবে নারীর ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদ্ধতি এতদিন ছিল না।
জার্মানির বার্লিনের চারিট ইউনিভার্সিটি হসপিটালের মেডিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক ও সাম্প্রতিক গবেষণা দলের সদস্য ক্রিস্টিন হাইম বলেন, ‘নারীর জননেন্দ্রিয় ঠিক কীভাবে মস্তিষ্কের স্পর্শ অনুভূতির অঞ্চলের সঙ্গে জড়িত এবং অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারের সঙ্গে এর ধরন পরিবর্তিত হয় কি না, সে বিষয়ে এখনও পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। আমরা এবার সেটি বের করার চেষ্টা করেছি।’
সাম্প্রতিক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের যৌনাঙ্গে স্থানীয়ভাবে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়েছে বিশেষ কৌশলে। এরপর তাদের মস্তিষ্কের অবস্থা বোঝার জন্য ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এফএমআরআই) করা হয়।
গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ এই যন্ত্রটি
দেহের মানচিত্র
মস্তিষ্কের যে অংশ দেহে বিভিন্ন স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে কাজ করে, সেটিই হলো সোমাটোসেনসরি করটেক্স। মস্তিষ্কের সামনের দিকের অংশের ঠিক পেছনেই এর অবস্থান। এই অংশটি দেহের বিভিন্ন অংশে স্পর্শের অনুভূতির তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে থাকে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সোমাটোসেনসরি করটেক্সের এসওয়ান (বিএওয়ান-বিএথ্রি) অঞ্চলটি নারীর যৌনাঙ্গে স্পর্শের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্লেষণ করে।
এই গবেষণায় নারীর যৌনাঙ্গে স্থানীয়ভাবে উদ্দীপনা তৈরির জন্য একটি বিশেষ গোলাকার বস্তু ব্যবহার করেছেন গবেষকেরা। এটি তাদের অন্তর্বাসের ওপর ক্লিটোরিসের সামনে রাখা হয়। এরপর গোলাকার বস্তুটিকে জেট বা নলবাহিত বাতাস দিয়ে কাঁপানো হয়েছে।
গবেষণায় অংশ নেয়া প্রত্যেক নারীকে আটবার ১০ সেকেন্ড করে উদ্দীপনা দেয়া হয় এবং প্রতিবারের মাঝে ১০ সেকেন্ডের বিরতি ছিল।
এই নারীদের মস্তিষ্কের এফএমআরআই ইমেজিং থেকে দেখা গেছে, পুরুষের মতো নারীর ক্ষেত্রেও সোমাটোসেনসরি করটেক্স যৌনাঙ্গের স্পর্শের অনুভূতি প্রক্রিয়াজাত করে। তবে নারীর ক্ষেত্রে সোমাটোসেনসরি করটেক্সে উদ্দীপনা বিশ্লেষণের অঞ্চলটি আলাদা। এমনকি একেক নারীর ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটির আকারও একেক রকম হতে পারে।
উদ্দীপনার সময় প্রত্যেক নারীর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সবচেয়ে সক্রিয় ১০টি অংশ চিহ্নিত করে তার পুরুত্ব মেপেছেন গবেষকেরা।
ক্রিস্টিন হাইম বলেন, ‘আমরা নারীদের যৌন মিলনের সংখ্যার সঙ্গে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলটির পুরুত্বের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। যারা বেশি যৌনতায় অংশ নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে জায়গাটির পরিধি বেশি পাওয়া গেছে।’
হাইম এর আগে ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখেছিলেন, যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের যৌনাঙ্গের সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের অংশগুলো দুর্বল ও সংকীর্ণ হয়ে গেছে।