ঢাকা নগর সেবা পরিবহন নাম দিয়ে রোববার থেকে চালু হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি বাসের পরীক্ষামূলক চলাচল। যাত্রীসেবায় এটি আমূল পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হলেও পরীক্ষামূলক অপারেশনে দায়সারা ভাব লক্ষ্য করা গেছে। সম্পূর্ণ নতুন বাস নামানোর কথা থাকলেও পুরনো বাসই মেরামত করে চালানো হচ্ছে।
সড়কের পাশে যাত্রীছাউনি থাকার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় তা দেখা যায়নি। আবার অনেক জায়গায় যাত্রীছাউনি ভাঙাচোরা। নির্ধারিত বাস স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলার কথা থাকলেও এর বাইরে কোথাও কোথাও নামানো হয়েছে যাত্রীদের।
দুই সিটি করপোরেশনের বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের এই সেবা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা হয়েছে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে। তবে এখনও বাস শেষ গন্তব্য কাঁচপুর পর্যন্ত যাচ্ছে না। এক স্টেশন আগে চিটাগাং রোড পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাচ্ছে। নগরবাসী এখনও এই পরিবহন এবং বাস স্টপেজগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বাসে যাত্রী তত বেশি নেই।
এই সেবার নতুন দিক হলো ই-টিকিট। কিলোমিটার হিসেবে ই-টিকিটিং সেবা দেয়ার কারণে ভাড়া আসে ১৩, ১৪, ২২, ২৬, ৩৭ টাকা ইত্যাদি অংকের। ঢাকায় যাত্রীরা সাধারণত ৫, ১০, ১৫, ২০ ইত্যাদি সংখ্যার ভাড়া দিয়ে অভ্যস্ত। কোনো খুচরা ভাড়া দেন না যাত্রীরা।
এই সেবার চিত্র দেখতে সোমবার সকালে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে শেষ স্টপেজ চিটাগাং রোড পর্যন্ত ঢাকা নগর পরিবহনের ট্রান্সসিলভা কোম্পানির একটি বাসে যাত্রা করেন নিউজবাংলার এই প্রতিবেদক।
ঘাটারচর থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত ২১টি বাস স্টপেজে বাস থেকে যাত্রী ওঠেন। বাস সুশৃঙ্খলভাবে নির্ধারিত বাস স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলে। বাসে ওঠার আগে কাউন্টার থেকে ই-টিকিট সংগ্রহ করতে হয় যাত্রীদের।
২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সব যাত্রীছাউনির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কয়েকটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ কারণে সব যাত্রীছাউনিতে বাস থামেনি। এ ছাড়া সায়দাবাদ থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত বেশির ভাগ জায়গায় যাত্রীছাউনি নেই। এসব জায়গায় বড় ছাতা টাঙিয়ে টিকিট কাউন্টার করা হয়েছে।
যাত্রী উঠানামায় একাধিক নির্ধারিত স্থানে দেখা গেছে যাত্রী ছাউনি নেই। কিন্তু টিকিট কাউন্টার আছে। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকা নগর পরিবহন ও রুটের চিত্র
ঘাটারচর থেকে যাত্রা শুরু হয় বেলা ১১টা ৩৯ মিনিটে। কিছু কিছু বাস স্টপেজ আগের স্টপেজ থেকে একটু দূরে হওয়ায় যাত্রীরা এখনও কাউন্টার চিনে উঠতে পারেননি। তারা আগের বাস স্টপেজেই দাঁড়িয়ে থেকে ওঠার চেষ্টা করেছেন। এ সময় বাসের হেলপার তাদের সামনের স্টপেজ থেকে টিকিট সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করেন। মোহাম্মদপুরে সিগন্যালে গাড়ি আটকে থাকায় কাউন্টারের বেশ আগে দুজন যাত্রী নামানো হয়।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দুই ছাত্র বাসে ওঠেন। তাদের হাফ ভাড়া নেয়া হয়েছে। ভাড়ার অঙ্কের পাশে লেখা (ছাত্রছাত্রীদের জন্য)। শংকর বাস কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা দূরের শৌচাগারে যাওয়ার কারণে যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারছিলেন না। এই স্ট্যান্ডের যাত্রীরা বলেন, কাউন্টারের পাশে শৌচাগার থাকা উচিত।
দুপুর ১২টা ৯ মিনিটে বাসটি ‘ধানমন্ডি ১৫’ নম্বর এলাকার কাউন্টারে পৌঁছায়। বাস দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেও টিকিট বিক্রেতাকে পাওয়া যায়নি। এ কারণে এই স্টপেজ থেকে কোনো যাত্রী উঠতে পারেননি।
ধানমন্ডি-১৫ নম্বরে নগর পরিবহনের যাত্রী ছাউনি দেখা গেছে। কিন্তু কোনও টিকিট কাউন্টার পাওয়া যায়নি। ছবি: নিউজবাংলা
সিটি কলেজের সামনে স্টপেজে যাত্রীছাউনি নেই। তবে কাউন্টার আছে। কাঁটাবন সিগন্যালে কাউন্টারের বাইরে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নামানো হয়। শাহবাগের আগে বাস চলন্ত অবস্থায় গতি কমিয়ে গাড়ি থেকে তিন যাত্রীকে নামায়।
শাহবাগ মোড়ে সিগন্যাল থাকার কারণে কাউন্টারের আগেই যাত্রী নামানো হয়। শাহবাগের আগের যাত্রীছাউনির কাজ এখনও শেষ করে কাউন্টার দেয়া হয়নি। তাই সেখানে বাস থামেনি। শাহবাগের কাউন্টারেও যাত্রীছাউনি নেই। রমনা পার্ক এলাকায় দুজনকে নামানো হয় কাউন্টার ছাড়া। তখন সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
রমনা পার্ক এলাকার টিকিট কাউন্টার পেরোলে মতিঝিল শাপলা চত্বরের আগে কাউন্টার নেই। ফলে গুলিস্তানের যাত্রীদের পল্টনের আগে মেহেরবা প্লাজার সামনে নামানো হয়।
এক নারী যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, গুলিস্তান যেতে চেয়ে কাউন্টারে টিকিট চাইলে তাকে গুলিস্তানের কথা বলে টিকিট দেয়া হয়। কিন্তু গাড়ি গুলিস্তান রুটের না হওয়ায় ওই নারীকে পল্টনে নামতে হয়। এতে ওই নারী হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
মতিঝিল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে তিনজনকে নামানো হয় স্টপেজ ছাড়া। মতিঝিল থেকে আরামবাগ মোড়ে গাড়ি ঘোরানোর সময় একজনকে নামানো হয় স্টপেজ ছাড়া। মতিঝিল ওভারব্রিজের নিচে কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই।
মতিঝিল আইসিবি ব্যাংকের বিপরীত পাশে সামনে যাত্রীছাউনির কাজ এখনও শেষ করে কাউন্টার দেয়া হয়নি, তাই বাস এই স্টপেজে থামেনি। সায়েদাবাদ লেভেল ক্রসিংয়ের আগে কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই। উত্তর যাত্রাবাড়ীতেও (সায়েদাবাদ ব্রিজের উত্তর-পূর্ব পাশে) কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই।
যাত্রাবাড়ী বিটিসিএলের সামনে কাউন্টারের সামনে আবর্জনার স্তূপ। অন্য পরিবহনের গাড়ির কারণে এই কাউন্টারের সামনে জটলা বেঁধে ছিল। বেলা ১টা ২০ মিনিটে কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা ছিলেন না। তাই দুজন টিকিট ছাড়া গাড়িতে ওঠেন। ড্রাইভার নিষেধ করলে তারা বলেন, হেলপার উঠতে বলেছে। পরে রায়েরবাগ স্টপেজ থেকে তাদের টিকিট দেয়া হয়।
যাত্রাবাড়ীতে নগর পরিবহনের টিকিট কাউন্টার বসানো হয়েছে পুরনো যাত্রী ছাউনিতে। আশপাশে ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা আর অচল গাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা
শনির আখড়ায় কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই। বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে বাস কাউন্টারে পৌঁছালে যাত্রী নিতে পারেনি। কারণ কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা ছিলেন না। তবে সেখানে অন্য সব পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতা ছিলেন।
মাতুয়াইল মেডিক্যাল বাসস্ট্যান্ডে কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই। এখানে একটু সামনে গিয়ে যাত্রী নামানো হয় চলন্ত বাস থামিয়ে। কারণ হিসেবে ড্রাইভার হেলপারকে বলেন, সামনে কাউন্টার নেই। সাইনবোর্ড স্টপেজে কাউন্টার আছে, যাত্রীছাউনি নেই। শিমরাইলে কাউন্টার ছাড়া চলন্ত গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নামানো হয়।
চিটাগাং রোড পর্যন্ত গাড়ি গিয়ে সব যাত্রী নামিয়ে একটু সামনে ব্রিজের নিচে দিয়ে গাড়ি ইউটার্ন করে ঘাটারচর ফেরার উদ্দেশে লাইনে দাঁড়ায়। তখন সময় বেলা ২টা।
কী বলছেন এই বাসের ড্রাইভার
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় এই বাসের চালকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্টপেজগুলো মেইন বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু সামনে হওয়ায় যাত্রীরা এখনও টিকিট কাউন্টার ওভাবে চিনে উঠতে পারেনি। এ কারণে যাত্রী কম হচ্ছে, গাড়ি ফাঁকা থাকছে।’
স্টপেজ ছাড়া যাত্রী নামানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকটি জায়গায় স্টপেজ ছাড়া যাত্রী নামাতে হয়েছে। কারণ যাত্রীরা এখনও সেবাটা বুঝে উঠতে পারেননি। আমরাও ঝামেলা না করে কিছু কিছু জায়গায় নামিয়েছি। রমনা পার্কের পরে টিকিট স্টপেজ মতিঝিলে। এই লম্বা জায়গায় স্টপেজ না থাকায় কয়েক জায়গায় যাত্রী নামাতে হয়েছে। না হলে যাত্রীদের হয়রানি হতো।’
নতুন জায়গায় কাউন্টারের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত বেশির ভাগ জায়গায় বড় ছাতা টাঙিয়ে টিকিট কাউন্টার করা হয়েছে। এই জায়গায় রাস্তার পাশে বাস দাঁড়িয়ে থাকায় টিকিট কাউন্টার চিনতে ঝামেলা হয়েছে। এ কারণে কয়েকটি কাউন্টারের একটু সামনে গিয়ে থামাতে হয়েছে বাস। যদি চিহ্ন হিসেবে একটা উঁচু নিশান টানিয়ে রাখত, তাহলে কাউন্টার চিনতে সুবিধা হতো।’
মেয়রের কথায় যাত্রীদের ক্ষোভ
নগর ভবনের বুড়িগঙ্গা হলে ১৯ ডিসেম্বর বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির ২০তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘সব মিলিয়ে ১০০টি বাস দিয়ে শুরু করতে যাচ্ছি। আগামী ২৬ ডিসেম্বর আমরা ট্রান্সসিলভার নতুন ২০টি বাস এবং বিআরটিসির ৩০টি ডাবল ডেকার বাস মেরামত করে সূচনা করব। বাকি কার্যক্রম ৬০ দিবসের মধ্যে পূর্ণভাবে এই যাত্রাপথ বাস্তবায়ন করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।’
তবে ট্রান্সসিলভার বাসগুলো নতুন নয় বলে দাবি করছেন যাত্রীরা। এই রুটের বেশ কয়েকজনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তারা বলেন, ট্রান্সসিলভার বাসগুলো সব পুরোনো। এগুলো রং করে রাস্তায় নামানো হয়েছে।
ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় ট্রান্সসিলভা পরিবহনের বাসের বাইরের দিক ঝকঝকে হলেও ভেতরে জরাজীর্ণ অবস্থা। ছবি: নিউজবাংলা
মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্সল্যাব যাবেন মো. আহাদ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই রাস্তায় ছয়বার যাওয়া-আসা হয়েছে আমার। এর মধ্যে চারবার ট্রান্সসিলভার কোম্পানির বাসে উঠেছি। সবগুলো বাস পুরোনো।’
এই পরিবহন সেবায় যুক্ত হতে আটটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে বিআরটিসিসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। ঢাকা নগর পরিবহনের চালকদের শনাক্তে দেয়া হয়েছে ইউনিফর্ম ও আইডি কার্ড।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে রোববার দুপুর ১২টার দিকে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ বাস রুট পাইলটিংয়ের উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে সচিবালয় থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ধীরে ধীরে এ সেবার বিস্তার হবে। আরও নতুন রুট যুক্ত হবে। রাজধানী ও আশপাশের এলাকার জন্য ৪২টি রুট করার পরিকল্পনা আছে।’
ঢাকা নগর পরিবহনে ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরত্বে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা; সর্বোচ্চ ভাড়া ৫৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসেবে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে।