প্রতি বেডেই রোগী। ভেতরে জায়গা না পাওয়ায় বারান্দাতেই শুয়ে আছেন অনেকে। সাধারণত এসব রোগীর ড্রেসিং করতে হয় প্রতিদিন। তবে ড্রেসিং রুম না থাকায় ওয়ার্ডে পর্দা টাঙিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। ইউনিটের প্রবেশপথ থেকেই রোগীর জটলা। একসঙ্গে দুইজনও হাঁটা যায়না সরু পথে। ডাক্তারদের বসার জায়গা নেই। আলাদা শৌচাগারও নেই।
শনিবার গিয়ে দেখা যায়, এভাবেই কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) বার্ন ইউনিট।
চিকিৎসকরা বলছেন, পোড়া রোগীদের শরীরে এমনিতেই বাড়তি যন্ত্রণা থাকে। এজন্য তাদের বাড়তি যত্ম দরকার হয়। যন্ত্রণা কমাতে এসি কক্ষ জরুরি। তবে এখানে সেসবের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে রোগীর যন্ত্রণা যেমন বাড়ছে, ইনফেকশনের ভয়ও থাকছে।
রামেকের পুরোনো বার্ন ইউনিটটিতে এখন করোনা রোগীর চিকিৎসা চলায় হাসপাতালের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের একাংশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাত্র ১৪টি বেড নিয়ে চলছে এখানকার ইউনিটটি। রোগী রয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রামেক হাসপাতালটি এখন রাজশাহী অঞ্চলের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের রোগীদেরও ভরসার জায়গা। প্রতিদিনই উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি খুলনা, কুষ্টিয়াসহ আশপাশের রোগীর চাপ থাকে এখানে।
দীর্ঘদিনের চাহিদা ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে হাসপাতালটিতে বার্ন ইউনিট চালু করা হয়। ওই সময় ২৪ শয্যা দিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা কার্যক্রম। তবে এত কম বেড দিয়ে রোগীর চাপ সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
এছাড়া ওই সময় রাজনৈতিক সহিংসতা শুরুর পর ওয়ার্ডেও চাপ বেড়ে যায়। রোগীর চাপ সামাল দিতে পরের বছরই এটিকে ৪৭ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে গত বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় একের পর এক ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ড বানানো হয়।
গত বছরের মার্চেই রামেকের বার্ন ইউনিটকে করোনা ওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়। পোড়া রোগীর চিকিৎসা শুরু হয় ছয় নম্বর ওয়ার্ডের এক প্রান্তে।
নতুন জায়গায় ১৪টি বেড দিয়ে চালু করা হয় বার্ন ইউনিট। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সামান্যও নেই সেখানে। পুরুষ-নারীর আলাদা ওয়ার্ডও নেই। একসঙ্গে গাদাগাদি করেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। নেই ওয়ার্ডের নিজস্ব শৌচাগারও।
১৪ বেডের ইউনিটে রোগী থাকে সবসময়ই ৩০ জনের বেশি।
আব্দুল মান্নান নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘এখানে পোড়া রোগীদের কষ্টের শেষ নেই। এমনকি তাদের ড্রেসিং করার কাজও করা যায় না। কাপড় টাঙিয়ে এসব করতে হয়।’
সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ‘এটি ইউনিট বলা হচ্ছে অথচ লজ্জার বিষয় এদের নিজস্ব ওয়ার্ডই নেই। অন্য ওয়ার্ডের অংশে চলছে পোড়া রোগের মতো চিকিৎসা। রোগীর যে চাপ হাঁটাহাঁটিও করা যায় না। ঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও রাখতে পারি না রোগীকে।’
এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করলেন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন।
তিনি বলেন, ‘বার্ন ইউনিটের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব কোনো ওয়ার্ড নেই। আমাদের এখানে নারী-পুরুষ সব ঢালাওভাবে একসঙ্গে ১৪টি বেডে থাকছে। মেঝেতে ও বারন্দাতে থাকছে। ড্রেসিং রুমও নাই আমাদের। মিনি ওটিও নাই। ১৪টি বেড দিয়েই চলছে। অথচ এখানে ৩০ জনের বেশি রোগী থাকে।’
ডা. আফরোজা নাজনীন বলেন, ‘শীতকালে রোগীদের মেঝেতে থাকাও কষ্টকর। বাতাসেও কষ্ট। শীতকালে রোগীরা কষ্ট বেশি পাচ্ছে। তাদের যে অংশটা পুড়ে গেছে সেখানে কোনো প্রকেটশন দেয়া যায় না। শীত হলে ঠাণ্ডা লাগে আবার গরম হলে গরম অনুভব করে।
‘মেঝেতে থাকার কারণে সেখান থেকেও তারা কষ্ট পাচ্ছে। এখানে একটি ভালো বেড দিতে পারছি না। ডাক্তারদের সাপোর্ট পেলেও প্রয়োজনীয় পরিবেশ না পাওয়ায় রোগীদের সুস্থ হওয়ার সময়ও বেশি লাগছে।’
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘বার্ন ইউনিটের নতুন একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এটির কাজ শুরু হবে। সেখানে ছয় তলা হবে। তখন এসব সমস্যা আর থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সেখানে বার্ন চিকিৎসার সব ফ্যাসিলিটি পাব। এখন রোীদের সমস্যা হচ্ছে। এদিকে আমাদের করোনার রোগীও থাকছে। আমাদের হাসপাতালের ক্যাপাসিটি কম। সংকটের কারণে আমরা অনেক কিছুই করতে পারছি না। আমরা সেখানে ম্যানেজ করছি।’