ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০-এর ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর অংশ হিসেবে সর্বোচ্চ গতি উঠিয়ে মেরামত চালিয়ে যাচ্ছিলেন নৌযানটির টেকনিশিয়ানরা।
লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বরগুনার কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা এ তথ্য পেয়েছে।
একাধিক যাত্রী জানান, সদরঘাট থেকে যাত্রার পর থেকেই লঞ্চটির গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান তা সারাতে কাজ করছিলেন। মেরামতের অংশ হিসেবে সর্বোচ্চ গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়।
ঢাকার সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে।
ইতালিপ্রবাসী বরগুনা সদরের হেউলীবুনিয়া এলাকার সাদিক মৃধা ওই লঞ্চের তিনতলার ক্যাবিনের যাত্রী ছিলেন। তিনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। লঞ্চটি অর্ধেকের বেশি পুড়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড উত্তাপ আর ধোঁয়ায় দম আটকে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায় তার। এরপর বাইরে নেমে দেখেন, চারদিকে আগুন। তিনি লঞ্চের পাশের ত্রিপলের রশি বেয়ে দ্রুত দোতলায় নামেন। সেখানে অনেক নারী, শিশুকে অজ্ঞান ও দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। ক্যাবিনে দুই শিশু ও এক নারীর দগ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
সাদিক বলেন, ‘কী করব ভেবে দিশেহারা হয়ে আমি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। পরে স্থানীয় লোকজন আমাকে উদ্ধার করেন।’
ওই লঞ্চের আরেক যাত্রী ফারুক হোসেন বলেন, ‘লঞ্চটি ঢাকার ঘাট ছাড়ার পর তিনি ইঞ্জিন রুমের কাছে গিয়েছিলেন। তখন ইঞ্জিনের বেপরোয়া গতি তুলে মেরামত সারতে চারজন টেকনিশিয়ানকে দেখতে পান।’
ফারুক ছাড়াও আরও কয়েকজন যাত্রী বলেন, ইঞ্জিনে সমস্যা থাকায় চারজন মেরামতকারী টেকনিশিয়ান লঞ্চটির ইঞ্জিনকক্ষে ছিলেন। তারাই মূলত পুরো গতিতে লঞ্চটিকে নিয়ে গিয়েছিল। ইঞ্জিনের ভেতরে জমে যাওয়া গ্যাস বের করতে এমনটি করছিলেন তারা। এতে ইঞ্জিন প্রচণ্ড গরম হয়ে পড়ে। ইঞ্জিনের ত্রুটি খুঁজে পেতে পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিনই চালাচ্ছিলেন তারা। বেপরোয়া গতির কারণে লঞ্চটি কাঁপছিল।
সাদিক বলেন, লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপকের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আর আগুন লাগার পরপরই মালিক ও স্টাফরা যাত্রীদের রেখে লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
তবে লঞ্চটির মালিক হাম জালাল শেখ দাবি করেন সেটিতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। এমনও বলেছেন, সেটিতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছিল।
তিনি দাবি করেছেন, আগুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত। গত ১০ মাসে দুইবার এই লঞ্চটির দুর্ঘটনা হয়েছিল বলেও তিনি জানিয়েছেন। তবে সেসব ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি।
সবশেষ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে চলার সময় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুন লাগে এমভি অভিযানে। যাত্রীদের অন্তত ৩৮ জন প্রাণ হারানোর পর প্রশ্ন ওঠে, যেসব নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, সেগুলো নৌযানটিতে ছিল কি না।
তবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, তাদের কাছে থাকা তথ্য মতে লঞ্চটির ফিটনেসে কোনো সমস্যা ছিল না।
এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
লঞ্চ মালিক জালাল কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে।
মোবাইল ফোনে তিনি জানান, গত নভেম্বরে ঢাকা থেকে পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় লঞ্চটির ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়। তবে যাত্রীরা বেঁচে যান। এরপর নতুন ইঞ্জিন বসানো হয়েছিল।
এর আগে গত আগস্টে ঝালকাঠির রাজাপুরের চরপালট গুচ্ছগ্রামের কাছে ডুবোচরে ৯ দিন ধরে আটকা পড়ে থাকে এই লঞ্চ।
জালাল বলেন, ‘লঞ্চে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না, ত্রুটি থাকলে নামাতে পারতাম না। মাত্র দুই মাস হলো জাপানি নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করেছি।’
তার দাবি, লঞ্চটিতে অন্তত ২১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল।
যদি যন্ত্র থাকে, তাহলে সেগুলো ব্যবহার করে কেন আগুন নেভানো গেল না, এই প্রশ্নে তার জবাব ‘আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি।’
একপর্যায়ে জালাল স্বীকার করেন, তার লঞ্চটির বিমা করা ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো লঞ্চের ইনস্যুরেন্স নেই। আমার কেন, কারও কোনো লঞ্চে ইনস্যুরেন্স নেই।’
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও সংস্থাটির ট্রাফিক ইনস্পেক্টর মো. কবির নিশ্চিত করেছেন, লঞ্চের বিমা বাধ্যতামূলক।
তাহলে এই লঞ্চটি বিমা ছাড়া কীভাবে চলছিল, সেই প্রশ্নে তারা বলেন, এ বিষয়টি কাজগপত্র দেখে বলতে হবে বিমা ছিল কি না।
জালাল জানান, লঞ্চের সুপারভাইজার আনোয়ার রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাকে ফোন করে আগুনের কথা জানান। এর ১০ মিনিট আগে বিস্ফোরণটি ঘটে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে প্রথমে আগুন ধরে। লঞ্চটির নিচতলায় ইঞ্জিন কক্ষের পাশের ক্যান্টিনে এই বিস্ফোরণ হয়।
মো. ইয়াসিন নামের এক ক্যান্টিন বয় গণমাধ্যমকে জানান, এই বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে ইঞ্জিন রুমে। এরপর তা ছড়ায় পুরো নৌযানে।
তবে লঞ্চ মালিক বলেন, ‘ইঞ্জিনে আগুন লাগলে কখনও পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে না। বিকট শব্দে দোতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ইঞ্জিনের দিকে ও ক্যাবিনের দিকে।’
আনোয়ারের খবরের বরাতে হাম জালাল বলেন, ‘প্রথমে দোতলায় একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন লাগে। তারপর তৃতীয় তলার ক্যাবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন।’
আগুনের ঘটনা পরিকল্পিত দাবি করে বলেন, ‘এত দ্রুত তিনতলা পর্যন্ত আগুন ছড়ানো অবিশ্বাস্য। দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে ও সরকারকে বিব্রত করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ইঞ্জিনরুমের আগুন ইঞ্জিনরুমেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং সেখানেই নেভানো যায়।’
জালাল জানান, তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে। তিনি ঢাকার গুলশান এলাকায় থাকেন। এখনও সেখানে আছেন বলে জানিয়েছেন।