করোনা মহামারি কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যে শ্রমবাজার, সেগুলো একে একে খুলতে শুরু করেছে। এর ফলে করোনায় কাজ হারিয়ে বা ছুটিতে দেশে এসে যেসব প্রবাসী কর্মী আটকা পড়েছিলেন, তাদের কাজে যোগ দেয়ার পথও খুলেছে।
এতে বাদ সাধছে মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ারলাইনসের টিকিটের মূল্য। যাত্রীদের অভিযোগ, সাধারণ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে তাদের। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই প্রবাসী কর্মীরা।
এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল এজেন্টরা বলছেন, কোভিডের সময়ে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট চালু হলেও অনেক ক্ষেত্রে কোভিড পূর্বাবস্থার মতো ফ্লাইট নেই। আগে যে রুটে একটি এয়ারলাইনস প্রতিদিন অন্তত একটি করে ফ্লাইট চালাত, সেখানে অর্ধেক সক্ষমতায় ফ্লাইট চলছে।
অন্যদিকে, শ্রমবাজার খুলে যাওয়ায় একটি টিকিটের বিপরীতে একাধিক চাহিদা তৈরি হচ্ছে। তার ওপর জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি এবং এয়ারপোর্টগুলোর বিভিন্ন ফি বেড়ে যাওয়ায় টিকিটের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
মধ্যপ্রাচ্য দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমানসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে অর্ধকোটিরও বেশি বাংলাদেশি বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। এসব দেশে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করে।
এর মধ্যে দেশি বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস বাংলা এবং বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে এমিরেটস, ইতিহাদ, ফ্লাই দুবাই, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ার, নাস এয়ার, কাতার এয়ারলাইনস, কুয়েত এয়ারলাইনস, ওমান এয়ার উল্লেখযোগ্য।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, নভেম্বর মাসে বিদেশে কাজে যোগ দিয়েছেন ১ লাখেরও বেশি প্রবাসী কর্মী। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছেন ৬৪ হাজারেরও বেশি। জুন পর্যন্ত অন্তত সাড়ে ৯ লাখ কর্মী বিদেশে যাবেন বলে ধারণা করছে মন্ত্রণালয়। টিকিটের মূল্য বেশি হওয়ায় এদের প্রায় সকলকেই বাড়তি ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও) নিয়মানুসারে সাধারণত এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রি হয় কয়েকটি ধাপে, যাকে বলা হয় স্ল্যাব। একই ফ্লাইটে একেক স্ল্যাবের টিকেটের মূল্য একেক রকম। এ কারণে যত আগে কেনা যাবে, ততই কম হবে টিকিটের দাম। আর সময় বাড়তে থাকলে টিকিটের দামও বেশি হবে। যেহেতু এখন যাত্রীর তুলনায় উড়োজাহাজের আসনের সংখ্যা কম, তাই টিকিটের দামও বেশি হচ্ছে।
ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব বলছে, সম্প্রতি সৌদি আরবে এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় প্রবাসী কর্মীরা যাওয়া শুরু করেছেন। এর বাইরে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দেশটিতে ভিজিট ভিসা (পর্যটন) এবং ওমরাহ ভিসাও চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতও বিপুল পরিমাণে ভিজিট ভিসা দেয়া শুরু করেছে। অন্য দেশগুলোও একই পদ্ধতি অবলম্বন করছে। এসব কারণে বাড়তি চাপ পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোতে।
আটাবের সেক্রেটারি জেনারেল মো. মাজহারুল এইচ ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেকগুলো কারণেই টিকিটের দাম বেশি। এখন এয়ারলাইনসগুলোকে বিশেষ কোনো ফ্লাইটের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। হয়ত যাত্রী আছে ৫ হাজার, কিন্তু টিকিট পাচ্ছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার। এতে করে বাকি ২ হাজার যাত্রী পরের ফ্লাইটের জন্য পেন্ডিং থাকছেন। আবার তারা পেন্ডিং মানে হলো এর পরের ফ্লাইটেও যাত্রীরা পেন্ডিং থাকবেন। এভাবেই এয়ারলাইনসগুলো ক্রাইসিসটাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে যাচ্ছে, ভাড়াও বাড়ছে।
‘আপনি এখন সিস্টেমে দেখবেন ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফ্লাইট ফুল হয়ে আছে। আড়াই মাস আগে যদি সবগুলো ফ্লাইট ফুল হয়ে যায়, এতে স্বাভাবিকভাবে চাপ থাকছে। এখন যদি একটা সেকশন তারা অ্যালাউ করত, তাহলে হয়ত চাপ কিছুটা কমে আসত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক ফ্লাইটের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ফ্লাইটের ভাড়া বেশি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভাড়া সমন্বয়ে এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি বলেন, ‘ফ্লাইটের ভাড়ার প্রতি আমরাও সংবেদনশীল। আমরাও চাই যেসব কর্মী প্রবাসে যায়, তারা যেন কম ভাড়ায় যেতে পারে। আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়েও মিটিং করেছি।
‘সিভিল এভিয়েশনকেও অনুরোধ করেছি সব এয়ারলাইনসকে নিয়ে তিনি বসবেন, আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষেও বসব এবং তাদের অনুরোধ করব যেন ভাড়াটা সহনীয় রাখা যায়। এটা যত দ্রুত করা যায় আমরা করব।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘আমি এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সবগুলো এয়ারলাইনসের সঙ্গে বসে আমাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছি। আমাদের যাত্রীরা যে বেশি টাকা দিচ্ছেন, তাদের ভাড়া কমাতে অনুরোধ জানিয়েছি।
‘তারা কেন ভাড়া বাড়িয়েছে, এটা জাস্টিফাই করার জন্য তাদের অনুরোধ করেছি। আর যদি না হয়, তাহলে আমরা কঠোর অবস্থানে যেতে পারি বলে তাদের সতর্ক করেছি।’
জেট ফুয়েলসহ সরকারি ফি বৃদ্ধির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘তারা বলছে ফুয়েলের দাম বেশি বা কোভিডের কারণে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ বেড়েছে। আমরা বলেছি, তারা যে গন্তব্যে যাচ্ছে, সেখানে তারা কত পেমেন্ট করে, আমাদের এখানে কত, যে ডিফারেন্সটা আছে, সেটা আমরা বলেছি তাদের হিসাব দিতে।
‘আমরা চেষ্টা করছি ভাড়া যাতে কমানো যেতে পারে। আশা করি, এটা সামনে ভালো অবস্থানে আসবে।’