বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কৃষকের ভাগ্য বাঁধা পাইকারি সিন্ডিকেটে

  •    
  • ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:১২

ময়মনসিংহের চরাঞ্চলের বোরোরচর ও চর সিরতা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন সবজির ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় শুধু সবজি আর সবজি। কৃষকদের কেউ কেউ ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন আবার কেউ সবজি তুলে খাঁচায় ভরছেন। ব্যস্ত সময় পার করছেন সবাই।

ব্রহ্মপুত্র নদ ঘেঁষা ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন সবজিভান্ডার হিসেবে খ্যাত। এখানকার চাষিরা এখন ক্ষেতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি করছেন ৪ থেকে ৫ টাকায়, অথচ সেই কপিই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়।

সাধারণ চাষিদের বিক্রি করা দাম ও শহরের ক্রেতাদের কেনা দামের এমন পার্থক্যের কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাদের কারণে একদিকে যেমন কৃষকের কোনো উন্নতি হয় না, আবার নিয়মিত ঠকছেন শহরের ক্রেতারা। এর মাঝে মুনাফা লুটছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এই এলাকার চাষিরা। তারা অভিযোগ করেন, এখানকার উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সবজি পাইকারদের মাধ্যমে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। সামান্য লাভে তারা এসব সবজি বিক্রি করছেন। অথচ সেই সবজিই বাজারে বিক্রি হচ্ছে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে।

চরাঞ্চলের বোরোরচর ও চর সিরতা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন সবজির ক্ষেত। যতদূর চোখ যায় শুধু সবজি আর সবজি। কৃষকদের কেউ কেউ ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন, আবার কেউ সবজি তুলে খাঁচায় ভরছেন। ব্যস্ত সময় পার করছেন সবাই।

কাজের ফাঁকে কথা হয় চর খরিচা গ্রামের কৃষক শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ১৮০ শতাংশ জমিতে বেগুন, টম্যাটো ও কাঁচা মরিচ চাষ করেছেন। কাকডাকা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষেতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন।

তিনি আরও জানান, ওই জমিতে সবজি চাষে তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকার বেশি। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ৬৫ হাজার টাকার সবজি। আরও কিছু সবজি খেতে রয়েছে। সব মিলিয়ে তার লাভ থাকবে ৪০ হাজার টাকার মতো।

শামসুল হক আফসোস করে বলেন, ‘ভোর ৫টা থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা ক্ষেত থেকে টাটকা সবজি নিতে ক্ষেতে ভিড় করেন। কিন্তু এত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কয়েক মাসে আমি যে টাকা লাভ করেছি, তার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি লাভে পাইকাররা বাজারে নিয়ে বিক্রি করেছেন।’

পরানগঞ্জের বীর বাওলা গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালেব জানান, ৪০ বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন। তবে ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেননি। ফসল বিক্রি করে পাওয়া টাকায় খাওয়া-দাওয়া, সংসারের খরচ ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় শেষ হয়ে যায়। ভবিষ্যতের জন্য কিছুই রাখতে পারেন না।

তিনি অভিযোগ করেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সব ধরনের সবজির দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। ভোরেই তারা গাড়ি নিয়ে সবজি ক্ষেতে যান। বর্তমানে তারা প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি করছেন ৪ থেকে ৫ টাকায়, অথচ সেই কপিই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রচুর সবজি একসঙ্গে কেনেন। সেই হিসেবে শ্রমিকসহ যাতায়াত খরচ যতই হোক, প্রতি পিস এত টাকা পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। এভাবেই সব ধরনের সবজি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন তারা।

শাহবাজার এলাকার কৃষক মাহতাব উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কৃষকরা কী হালে আছেন কখনও খোঁজ নেন না কৃষি কর্মকর্তারা। সরকারিভাবে কোনো ধরনের সহায়তা পাওয়া যায় না। আমরা বীজ কেনার সময় দোকান থেকেই বপনের বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে থাকি।

‘মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রোগে ফসল মরে যায়। তবুও নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রমে কষ্টের ফসল উৎপাদন করি। কৃষি কর্মকর্তারা যদি মাঠে এসে দিকনির্দেশনা দিত, তাহলে হয়তো আরও বেশি সবজি উৎপাদন হতো।’

ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজারে আড়তদার জয়নাল আবেদীন নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, পাইকাররা চরাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে খুব ভোরে ওই বাজারে সবজি নিয়ে যান। সেখান থেকেই তারা সবজি সংগ্রহ করেন৷ প্রান্তিক চাষিরা এসব পাইকারের কাছে কত টাকায় বিক্রি করেছেন তা তাদের বলা হয় না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করলে, আমরাও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আরেকটু বেশি দামে বিক্রি করি। এতে ক্রেতারা বেশি দামে সবজি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বেচাকেনায় আমাদের তেমন লাভ না হলেও গাড়িভর্তি করে নিয়ে আসা সবজির পাইকাররা চরম লাভবান হচ্ছেন।’

ওই বাজারে নিয়মিত সবজি নিয়ে যান পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হাশেম৷ জমি থেকে কম দামে সবজি কেনার পরও বাজারে ৪ থেকে ৫ গুণ দাম বাড়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, তারা মণ হিসেবে সবজি কেনেন। গাড়ির খরচ আর শ্রমিকদের বেতন দেয়ায় তাদের সবজি বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। কৃষকরা সবজি না দিলে তো তারা কিনতে পারবেন না। সিন্ডিকেট করে কৃষকদের ঠকানো হচ্ছে না।

কপির দামের পার্থক্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সত্যি। এই সবজিতেই একটু বেশি লাভ হয়। মাঝেমধ্যে কিছু সবজি নষ্ট হলে এ সবজির দাম দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায়।’

আবুল হাশেমের দাবি, চরাঞ্চলের এসব সবজিতে তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ান না। তবে ঢাকায় সবজি নিয়ে পাইকাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায় কি না সে বিষয়ে তার জানা নেই।

সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তাহমিনা ইয়াসমিন জানান, গত বছর তিন হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের কোলঘেঁষে তৈরি হয়েছে বিশাল সবজির হাব বা কেন্দ্র। গত বছরের চেয়ে এবার আরও বেশি জায়গাজুড়ে সবজি চাষ হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘শুধু বোরোর চর ইউনিয়নে কাঁচা মরিচই চাষ হয়েছে ৪২০ হেক্টর জমিতে। প্রাথমিকভাবে এখানকার কাঁচা মরিচ দেশ ছাড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপেও। এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের কিছু লোকজন এসে ওই এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

‘ইতিমধ্যে ৬০ জনের বেশি কৃষককে নিয়ে তিনটি রপ্তানিকারক দল করা হয়েছে। সবজি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস এলাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এ নিয়ে বেশ অগ্রসরও হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন হলে রপ্তানি হবে। সে ক্ষেত্রে ন্যায্য দাম পাবেন কৃষকরা।’

চাষিদের অভিযোগ থাকলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মতিউজ্জামান দাবি করেন, কৃষি কর্মকর্তারা চাষিদের সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন সময় কৃষকদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। এ কারণে অনেকে বেশি পরিমাণ জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে, কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘শীতকালে বেশি সবজি উৎপাদন হওয়ায় দাম কিছুটা কম থাকে। কৃষকরা একসঙ্গে টাকা পেতে খুব কম দামে পাইকারদের কাছে সবজি বিক্রি করেন। মূলত এ সুযোগেই অসাধু পাইকাররা সিন্ডিকেট করে চড়া দামে বিভিন্ন সবজি বিক্রি করেন।’

এ বিভাগের আরো খবর