ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ও পরিচালক (প্রশাসন)-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ১৫ নভেম্বর দুদক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমির জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি ও ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসেন ও পরিচালক প্রশাসন মো. হাবিবুর রহমান।
ওই চিঠির একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা, আর এর সত্যতা যাচাইয়ে করতে গিয়ে জানা যায়, চিঠিটিই ভুয়া। এই চিঠি সম্পর্কে কিছুই জানেন না অভিযোগকারী হিসেবে যার নাম রয়েছে তিনি নিজেই!
অভিযোগে যা আছে
চিঠিতে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ও পরিচালক প্রশাসনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। প্রথমেই উল্লেখ করা হয় দুই জনের সম্পদের হিসাব। সেখানে বলা হয়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেনের কুমিল্লায় তিনটি বাড়ি ও পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে, মিরপুর ডিওএইচএস ও বনানীতে আছে ১১টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, উত্তরা ও ধানমন্ডিতে আছে তিনটি বাড়ি। এ ছাড়া ঢাকায় একাধিক জমিসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে তিনি গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। একই সঙ্গে শত কোটি টাকা ডলারে রূপান্তর করে নিজ বাসায় মজুদ করে রেখেছেন তিনি।
অন্যদিকে পরিচালক প্রশাসন হাবিবুর রহমান সম্পর্কে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও ঢাকায় তার রয়েছে একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ছয়টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, জমিসহ আত্মীয়-স্বজনদের নামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। আর এসব সম্পদ তারা অর্জন করেছেন ফায়ার সার্ভিসের নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে।
অভিযোগে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিসের এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আমলে পাঁচ হাজার জনবল নিয়োগ হয়। এর মধ্যে অন্তত চার হাজার নিয়োগ তারা দুজন বেআইনিভাবে অর্থের বিনিময়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়মিত বদলি বাণিজ্য করছেন মহাপরিচালক ও পরিচালক প্রশাসন।
এর বাইরেও অভিযোগ করা হয়, রাষ্ট্রের টাকায় নিম্নমানের ফায়ার ফাইটিং সরঞ্জাম ও গাড়ি ক্রয় ও গাড়ি ঠিকমত মেরামত না করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণেও নানা অনিয়ম করেছেন দুজন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নিউজবাংলা কথা বলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ও পরিচালক প্রশাসনের সঙ্গে। তারা দুজনেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। কিন্তু এর সত্যতা কতটা, সেটা হলো মূল বিষয়। আমার এতো এতো সম্পদের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো আমাকে প্রমাণ করে দেয়া হোক। বলা হয়েছে, আমার অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে, বাস্তবে আমার ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট আছে, কিন্তু বলা হচ্ছে ১১টি ফ্ল্যাট। কুমিল্লায় যে পৈত্রিক সম্পদ ছিল, তার অধিকাংশই বিক্রি করে দিয়েছি। আবার বলা হচ্ছে, বাসায় ডলার মজুদ করে রাখা আছে, যার সবই কাল্পনিক।
‘আর বলা হচ্ছে, আমি নাকি নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে জড়িত। অথচ আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অনেক ফায়ার সার্ভিস কর্মীর বিরুদ্ধে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আগে সবাই নিজ জেলায় পোস্টিং নিয়ে বসে থাকত, এখন আর কাউকেই নিজ জেলায় কাজ করতে দেয়া হয় না। এই সিদ্ধান্তের কারণে বদলি বাণিজ্য একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন উল্টো আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে।’
বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমির জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে প্রকল্পের সবকিছুই এখনও প্রস্তাবিত, সেই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিষয় আসে কীভাবে, তা আমার বোধগম্য নয়।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশাসন) মো. হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সুরক্ষা বিভাগ, জনপ্রশাসন বিভাগ ও পিএসসি বিভাগের একাধিক প্রতিনিধি থাকেন। এদের মধ্যে পিএসসির প্রতিনিধি একেক দিন এক এক জন আসেন। সবার মূল্যায়নে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আমরা দুর্নীতি করলে তো বিষয়টা তাদের নজরে আসার কথা।
‘আর এখানে ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের বিষয়ে। যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তাহলে বলা হোক যে, কার কাছে থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে।’
গাড়ি মেরামত না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে চীন সরকারের কাছ থেকে প্রচুর গাড়ি পেয়েছি অনুদান হিসেবে, তার মধ্যে অধিকাংশ গাড়ি অচল হয়ে পড়ে আছে। কারণ একে তো সেগুলো নিম্নমানের গাড়ি, অন্যদিকে এগুলো যেহেতু অনুদানের গাড়ি, তাই মেরামতের জন্য কোনো বরাদ্দ থাকে না। তাই এসব গাড়ি মেরামতের কোনো সুযোগ নেই।’
‘অভিযোগকারী’ নিজেই জানেন না চিঠির বিষয়ে
গত ১৫ নভেম্বর দুদকে এই অভিযোগটি ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তার নামে দায়ের করা হয়। ১৭ নভেম্বর চিঠিটি দুদক গ্রহণ করে। এর একটি অনুলিপি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর।
চিঠির তথ্য অনুযায়ী, অভিযোগটি দেন সিলেট ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের অয়্যার হাউজ পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি জানান, এই চিঠি তার লেখা নয়। এমনকি তিনি কোনো অভিযোগ দুদক কিংবা সুরক্ষা সচিবের কাছেও দেননি।
চিঠির অনুলিপি পাঠালে মিজানুর রহমান নিশ্চিত করেন স্বাক্ষরের জায়গায় হাতের লেখাটিও তার নয়। তার আলাদা স্বাক্ষর নমুনা রয়েছে, কিন্তু চিঠিতে বাংলা অক্ষরে পুরো নাম লেখা রয়েছে।
তার নাম ব্যবহার করে কারা এ কাজ করল আর কেনইবা করা হলো, জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘তা তো নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে এটা যে আমার আর স্যারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, তা বুঝতে আর বাকি নাই। আমার আশপাশে অনেক সহকর্মী আছেন, যারা আমাকে খুব ঈর্ষা করেন। আমি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি জার্মানিতে যাব, ছুটি যেন না পাই সে জন্য তাদের কেউ হয়তো করতে পারে। আবার এখন নতুন নিয়মের কারণে আমাদের অনেকেই চাইলেই বদলি হতে পারেন না, ডিজি স্যার এসে খুব কড়াকড়ি করেছেন। সে জন্যও হয়তো কেউ আমার নাম ব্যবহার করে এটা করতে পারে।’
অভিযোগ উঠল কেন
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মী বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য ও নানান অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জন চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আরও অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। সেই সঙ্গে বদলির বিষয়ে করা হয়েছে নতুন নিয়ম। সে অনুযায়ী নিজ জেলার ৬০ কিলোমিটারের আশপাশে কাউকে পদায়ন করা হচ্ছে না। এ নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অনেক কর্মীর মধ্যেই আছে অসন্তোষ। আর সে কারণেই কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে এই অভিযোগটি দিতে পারেন বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ও পরিচালক।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা নানা সময়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের বেশ কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা নানা সময়ে নিয়োগের কথা বলে সাধারণদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। আমরা যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছি। আরও কিছু ইনকোয়ারি চলছে।
‘আগে দেখা যেত কর্মীরা নিজ নিজ জেলায় পদায়ন নিয়ে বসে থাকতেন। এতে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার যেমন বেশি থাকত, পাশাপাশি কোনো আগুনের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ফায়ার ফাইটারদের পাওয়া যেত না। নিজের বাসার পাশে অফিস হওয়ায় অনেকে অফিসে না থেকে বাসায় বা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তাই আমরা নিয়ম করে দিয়েছি, নিজ জেলায় কোনো ভাবে পদায়ন করা হবে না।
‘এভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, যা অনেকের মনঃপুত হয়নি। তাদের মধ্যে সংক্ষুব্ধ কেউ এই কাজ করে থাকতে পারে।’
দুদক কী বলছে
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরেফ সাদেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভিযোগ আসতে পারে, তবে এমন কোনো বিষয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত দুদক এখনও আমলে নেয়নি। কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে দুদকের প্রাইমারি ইনকোয়ারি কমিটি তা যাচাই করে। সেখানে প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর বিষয়টি সংখ্যা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। একটি বিষয় অনুসন্ধানের যোগ্য হতে হলে শতকরা ৮০ শতাংশ নম্বর পেতে হয়।
‘ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি যদি প্রাথমিকভাবে তদন্তে প্রমাণ হয় তবে এটা নিয়ে দুদক কাজ করবে, নইলে তা বাতিল হয়ে যাবে।’
অভিযোগকারীর নাম ব্যবহার করে কেউ এ চিঠি দিয়ে থাকলে তখন কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখন এই বিষয়ের মূল্যায়ন কমে যাবে।’
এদিকে এমন কোনো অভিযোগের বিষয়ে জানা নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এমন কোনো চিঠি পাইনি বা মৌখিক অভিযোগও পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের এত বড় বড় দুর্নীতির কথা আমি প্রথম আপনার মুখ থেকেই শুনছি। এমন কিছু ঘটলে আমার জানা থাকত।’