সালটা ১৯৭১। ডিসেম্বরের ১৬। বাঙালির বিজয়ের সকাল।
চারদিক থেকে তখন ভেসে আসছে বিজয়ের বার্তা। লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন বীর যোদ্ধারা। হতোদ্যম
পাকিস্তানিরা প্রস্তুতি নিচ্ছে আত্মসমর্পণের। ৯ মাসের রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধ শেষ। সবখানেই বিজয় উল্লাস। নতুন পাওয়া স্বাধীনতার সুখে সবাই বাঁধনহারা।
বিজয়ের এই সকালে বিমান থেকে একটি মর্টার শেল এসে পড়ে সিলেট শহরের মণিপুরী রাজবাড়ী এলাকার একটি বাসায়।
যুদ্ধের সময়ে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন ডা. দিগেন্দ্র চন্দ এন্দের পরিবার। বিজয়ের খবর শুনতে ঘরের একটি কক্ষে রেডিওকে ঘিরে বসেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যান সবাই। প্রাণ হারান এই পরিবারের ৯ জন।
কোনো বিমান থেকে ফেলা বোমায় শহীদ হন এই ৯ জন, নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। তবে অনেকের ধারণা, ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান থেকেই পড়েছিল লক্ষভ্রষ্ট মর্টার শেলটি।
শহীদ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দাবি এমন। পাশের পাকিস্তানি ক্যাম্প লক্ষ্য করে ছোড়া ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মর্টার শেলেই ৯ জন প্রাণ হারান বলে মনে করেন তারা।
গণকবরের সামনে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ছবি:নিউজবাংলা
যার বোমাতেই এ বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে থাকুক, তারা সবাই যুদ্ধের শিকার। তবে এখন পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই এই শহীদদের। কোনো তালিকায়ও নাম নেই তাদের। বিজয় উল্লাসের নিচে চাপা পড়ে যায় এই পরিবারের কান্না। চাপা পড়ে যান শহীদেরা।
এমনকি যে স্থানে সমাহিত করা হয়েছিল এই শহীদদের, সেই স্থানটি সংরক্ষণেরও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেই। সমাধিস্থলে এখন গড়ে উঠেছে দোকানপাট।
বিজয় দিবসে বাঙালির সবচেয়ে আনন্দের দিনটি দিগেন্দ্র চন্দ এন্দের পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যক্তিগত বিষাদের। ৫০ বছরেও স্বীকৃতি না পাওয়ার আফসোসেরও।
শহীদ ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দের নাতি প্রতীক এন্দ সিলেটের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। একাত্তরেই জন্ম তার। ডিসেম্বরে বয়স ছিল মাত্র এক মাস। বাবা পার্থ শখা এন্দের মুখে শুনেছেন পারিবারিক সেই ট্র্যাজেডি। পার্থ শাখাও আহত হয়েছিলেন সেদিন।
বাবার মুখে শোনা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতীক এন্দ জানান, ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ ছিলেন সিলেট পৌরসভার চিকিৎসক। একাত্তরের আগেই তিনি অবসরে চলে যান। তবে যুদ্ধকালীন অনেককে সেবা দিয়েছেন। তিনি পরিবার নিয়ে মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
এন্দ বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিবারের নারী সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পার্শ্ববর্তী মণিপুরী রাজবাড়ী এলাকার একটি বাসায় সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেন। তখন ওই বাসায় থাকতেন দাদার বন্ধু আব্দুর রহমান চৌধুরী।’
বাবার মুখে শোনা ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে প্রতীক এন্দ বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বরের সকালে সব দিক থেকে বিজয়ের খবর ভেসে আসছে। আমার দাদা ঘরের সবাইকে নিয়ে রেডিওতে এসব খবর শুনছিলেন। সকাল তখন প্রায় ৯টা। এমন সময় বিমান থেকে মর্টার শেলটি এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ, তার স্ত্রী সুরুচি বালা এন্দ এবং আত্মীয় প্রকৌশলী গোপেশ দাস। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেলে মারা যান দিগেন্দ্র চন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিব্যেন্দু এন্দ, মেয়ে শিখা এন্দ এবং দিব্যেন্দু এন্দের ছেলে অপু এন্দ।’
আহত অবস্থায় হাসপাতালে থেকে তিন দিন পর মারা যান দিগেন্দ্রের আরেক মেয়ে শিবানী এন্দ ও সাত মাসের শিশুকন্যা পম্পা এন্দ। সাত দিন পর মারা যান দিগেন্দ্রের পুত্রবধূ খনা এন্দ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক ও শহীদ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের তালিকা নিয়ে ড. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের সম্পাদনায় ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ। এই বইয়ে উল্লেখ রয়েছে ডা. দিগেন্দ্রের জীবনী ও তার পরিবারের আত্মদানের কথা। এ ছাড়া তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সিলেটে গণহত্যা’ বইয়েও রয়েছে এ কাহিনীর উল্লেখ।
দিগেন্দ্র এন্দের পরিবারের শহীদ সদস্যদের সেদিন হিন্দু রীতিতে সমাহিত করা যায়নি। এমনটি জানিয়ে প্রতীক এন্দ বলেন, ‘তখনও তো যুদ্ধাবস্থা। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দাহ করার জন্য শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়ার সাহস করেনি কেউ। বিজয় দিবসের দিন ও তিন দিন পর মারা যাওয়া সাতজনকে মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় গণকবর দেওয়া হয়। সাত মাসের শিশু শম্পার মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে। শুধু সাত দিন পর মারা যাওয়া খনা এন্দকে দাহ করা হয়েছিল।’
দিগেন্দ্র এন্দ পরিবারের সাত সদস্যকে যেখানে সমাহিত করা হয়, সেটি নগরের নয়াসড়ক এলাকার বিশ্বম্ভর আখড়ার জমি।
সোমবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গণকবরের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই; বরং যে জায়গায় সমাহিত করা হয়েছিল, সেখানে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক স্থাপনা, দোকানপাট।
সমাধিস্থল সংরক্ষণ না করা ও শহীদদের স্বীকৃতি না মেলায় আফসোস জানিয়ে প্রতীক এন্দ বলেন, ‘আমরা আর্থিক সহায়তা চাই না। শুধু স্বীকৃতিটুকু চাই। আমার দাদাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানাই।’
একই দাবি সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মনেরও। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা ছিলাম বিমানবন্দর এলাকায়। বিকেলে শহরে প্রবেশ করেছি। পরে এই ঘটনা শুনেছি।’
কাদের বিমান থেকে বোমা পড়েছিল, এমন প্রশ্নে ভবতোষ বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর কোনো পাকিস্তানি বিমান উড়তে দেওয়া হয়নি। তার আগেই বিমানবন্দর দখলে নেওয়া হয়েছিল। ফলে মিত্রবাহিনীর বিমান থেকেই মর্টার শেল পড়ার আশঙ্কা বেশি।’
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘কার গুলিতে মারা গেছেন, এটা বড় প্রশ্ন নয়, তারা সবাই যুদ্ধের শিকার। স্বীকৃতি ও শহীদের মর্যাদা তাদের প্রাপ্য।’
দিগেন্দ্র চন্দ এন্দের পরিবারের সদস্যদের গণকবরটি সংরক্ষণ ও তাদের স্বীকৃতির দাবি জানায় বিভিন্ন সংগঠন। ছবি: নিউজবাংলা
রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি। গণকবর চিহ্নিত নেই। মানুষজনও ভুলে গেছে। তাদের মৃত্যুর দিনটি স্মরণ করে না কেউ। ব্যতিক্রম শুধু কিছু তরুণ। ছাইভস্ম থেকে তারা খুঁড়ে বের করছেন ইতিহাস। কয়েক বছর ধরে তারা স্মরণ করেছেন এই শহীদদের।
এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সিলেটের নাগরিক সংগঠক আব্দুল করিম কিম। তিনি যুদ্ধের সময় দিগেন্দ্র এন্দের পরিবারকে আশ্রয় দানকারী আব্দুর রহমান চৌধুরীর ছেলে।
কিম বলেন, ‘বাবার কাছে এই ইতিহাস জানার পর আমরা এই শহীদদের স্মরণের উদ্যোগ নেই। কয়েক বছর ধরে তা নিয়মিতভাবেই করে আসছি। এ রকম একটি স্মরণ অনুষ্ঠানে সিলেট সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান উপস্থিত হয়ে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে এরপর সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।’
এ বছরও ১৬ ডিসেম্বর সকালে ‘বিশ্ব সিলেট সম্মিলন আয়োজক কমিটির’ উদ্যোগে ‘লেখা আছে অশ্রুজলে...’ নামে একটি স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী গণকবরটি সংরক্ষণের দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন।