রাজধানীর চেয়ারম্যানবাড়ি সংলগ্ন ইউলুপে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় পা হারিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজং। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল চালিয়ে মনোরঞ্জন উল্টোপথে ইউলুপ পার হচ্ছিলেন।
মনোরঞ্জনের মোটরসাইকেল ইউলুপ পেরিয়ে মূল রাস্তায় ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে একটি প্রাইভেট কার ইউলুপে প্রবেশ করতে গেলে মোটরসাইকেলটির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে গুরুতর আহত হন মনোরঞ্জন।
গত ২ ডিসেম্বর রাতে ঘটনার পর মনোরঞ্জনের মেয়ে সার্জেন্ট মহুয়ার মামলা না নেয়া, নানা সমালোচনায় দুই সপ্তাহ পর বনানী থানার মামলা নেয়া এবং মামলা নেয়ার দুদিন আগে প্রাইভেট কারটির চালক বিচারকের ছেলে সাঈদ হাসানের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়া – এ বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ির ইউলুপে ঘটা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইন কী বলে?
এই প্রশ্ন করা হয় ডিএমপি বিভিন্ন এলাকায় সড়কে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টদের কাছে, যারা এমন ঘটনা-দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ করে থাকেন এবং আদালতে এগুলোর বিচার প্রক্রিয়ায় যাদের অংশ নিতে হয়।
তারা বলছেন, উল্টো পথে আসায় মনোরঞ্জন হাজং অপরাধ করেছেন। ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী হলেই তাকে চাপা দেয়ার দায় থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। গাড়িটি গতিসীমার চেয়ে দ্রুত বেগে গাড়ি চলছিল কিনা এবং লেন ঠিকমতো মেনেছে কিনা, তাও দেখতে হবে। এসব কারণে গাড়ির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন কিনা, সেটাও বিবেচ্য।
দুর্ঘটনার সময় সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রাইভেটকারের চালক দ্বিতীয় লেন থেকে প্রথম লেনে দ্রুত চলে আসেন এবং ডান পাশে টার্ন নেয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে ওভারস্পিডিংয়ের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি বনানী থানা পুলিশ।
এই দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ পর মামলা হয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনাটি মধ্যরাতে হওয়ায় এটির প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে সড়কে স্পিডোমিটার না থাকায় বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসানের গাড়িটি কত গতিতে এসে ডানে মোড় নেয়, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশে সিসিটিভি ফুটেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিতে প্রাইভেটকারটি চলতে দেখা গেছে। লেন না মেনে দ্বিতীয় লেন থেকে গাড়িটি ডানে টার্ন নেয়ায় ইউলুপের প্রবেশমুখে বাম পাশের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আহত হন মনোরঞ্জন।
গুলশান বিভাগের একজন ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, বনানীর দুর্ঘটনায় প্রাথমিকভাবে দুই পক্ষরই দোষ দেখা যায়। উল্টো পথে আসায় মনোরঞ্জন হাজং সড়ক পরিবহন আইনের ৪৯-এর ঘ ধারায় অপরাধ করেছেন। এই অপরাধের শাস্তি হবে একই আইনের ৯২ ধারায়, যাতে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড এবং চালকের দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা যাওয়ার কথা বলা আছে।
এই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রাইভেটকারের চালক ওভার স্পিডিং করে থাকলে তার অপরাধ হবে ৪৪ ধারায়। আর এই ওভার স্পিডিংয়ের কারণে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হলে ৯৮ ধারায় শাস্তি হবে। সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ১০৫ ধারা।
৯৮ ধারায় তিন বছর কারাদণ্ড, বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের কথা বলা আছে। এই অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার আদেশ দিতে পারবে আদালত।
১০৫ ধারায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
ঘটনার প্রেক্ষিতে এসব আইনের কথা জানালেও ট্রাফিকের সার্জেন্টরা জানান, এই ঘটনায় আরো কিছু ধারা যুক্ত হতে পারে। গাড়ির চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স যদি না থাকে বা তিনি মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত থাকেন, তাহলে আলাদা ধারা যুক্ত হবে।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সড়কে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ কাউকে আঘাত বা চাপা দিয়ে আহত বা মেরে ফেলতে চায় না। পরিস্থিতির কারণে ঘটে থাকে। তদন্তে সব বিষয় উঠে আসবে। কেন দুর্ঘটনা ঘটল, তা বের করাই তদন্তের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে।
মহুয়া হাজংয়ের মামলাটি তদন্ত করছেন বনানী থানার উপপরিদর্শক সালাউদ্দিন মোল্লা। বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসানের করা সাধারণ ডায়েরিটি (জিডি) তদন্ত করছেন একই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর গাজী। তারা কেউই তদন্তের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া বলেন, ‘এই দুর্ঘটনায় মহুয়া হাজং বাদি হয়ে দায়ের করা মামলাটি সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ও ৯৮ ধারায় হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। অন্য কোনো অপরাধ পাওয়া গেলে সেই অপরাধ অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদনে নতুন ধারা যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।’