দেশে সরকারি হিসেবে মিনিকেট ধানের চাষ হওয়ার কোনো তথ্য না থাকলেও বাজারে কীভাবে এই নামে চাল আসে, তা নিয়ে দুই রকম ব্যাখ্যা শোনা গেছে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের কাছ থেকে।
মন্ত্রী বলছেন, জিরাসাই বা শম্পা কাটারির মতো ধান থেকে পাওয়া চালকে মিনিকেট নামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। আর সচিব বলছেন, বাজারে থাকা সব ধরনের মোটা ও মাঝারি চাল পলিশ করে মিনিকেট চাল নামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
সচিবালয়ে সোমবার আন্তর্জাতিক পুষ্টি অলিম্পিয়াড সামনে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে মিনিকেট চাল প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তাদের কাছে এই মত পাওয়া যায়।
মিনিকেট হলো ব্র্যান্ড নেম: সচিব
সংবাদ সম্মেলনে মিনিকেট চাল প্রসঙ্গে খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একটি রিসার্চ ওয়ার্ক করিয়েছি। প্রায় ১০টি জেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষের কাছে তথ্য নিয়েছি। এটা সত্যি কথা, বাজারে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু ধান মিনিকেট নেই বললেই চলে। এটা আসলে মিনিকেট না।
‘কৃষি মন্ত্রণালয় এখন স্বীকার করছে, একসময় বিদেশ থেকে ধান ও বীজ আনা হয়েছিল। তখন সেই কিটের নাম অনুসারে সেই ধানের নাম গ্রামের লোকেরা মিনিকেট দিয়েছিল। এখন আবার নাজিরশাহী বলছে, কেউ মিনিকেট বলছে, ২৮ ধানকেও মিনিকেট বলছে, মোটা ধানকেও মিনিকেট বলছে। আমরা কিন্তু এখন একটি ছাঁটাই নীতিমালা করছি। এই গবেষণার ফলটা আমরা রিলেটেড বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ওখানে আমরা এটা পেয়েছি যে ধান যেটাই উৎপাদন হোক, নাম মিনিকেট। এটা তাদের ব্র্যান্ড নেম। এখন আমরা চেষ্টা করব ব্র্যান্ডিং আপনার যা-ই হোক, সেখানে ধানের নাম লিখতে হবে। এ কাজটাই আমরা এখন করছি।
‘এটাকে কিন্তু বিআরআরআই (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) স্বাস্থ্যঝুঁকি বলছে না, পুষ্টি উপাদান চলে যাচ্ছে। কারণ একটি ধান ছাঁটাই করা যাবে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ছাল ছাড়ানোর পর ৮ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে। কিন্তু অনেক জায়গায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করা হচ্ছে, কৃষি মন্ত্রণালয় এটা বলছে। আমরা এ জন্য নীতিমালা করছি।’
খাদ্যসচিব বলেন, ‘আপনি তো মোটা চাল খান না, পলিশ ছাড়া খান না। আমি যখন হাসকিং মিলে চালের অর্ডার দিচ্ছি, তখন বলছি পলিশ করে দিতে হবে। এটাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
‘বারবার পলিশ করতে করতে এখন আর চেনা যায় না এটা কোন জাতের ধান। ধানের জাতের নাম বস্তায় লিখে দিতে হবে।’
ধান ছেঁটে মিনিকেট তৈরির তথ্য ঠিক নয়: মন্ত্রী
বাজারে মিনিকেট নামে কোনো ধান না থাকার কথা মানছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও। তবে তার মতে, চাল ছেঁটে মিনিকেট তৈরির তথ্যে সত্যতা নেই। তিনি বলেন, ‘অরিজিনালি মিনিকেট ধান নেই। এখানে চালটা যেটা সরু মিনিকেট খান সেটা হলো জিরাসাই, শম্পা কাটারি এই দুই রকমের ধান বেশি। এটাকে নাজিরশাহীও বলে। পাইজাম আছে, লাল পাইজাম আছে, সুপার পাইজাম আছে। কিন্তু এখন ব্র্যান্ডটা তারা মিনিকেট বলে চালাচ্ছে।
‘এখন ২৮কেও মিনিকেট বলে, ২৯কেও মিনিকেট বলে চালায়। আবার সুপার মিনিকেট থাকে, যেটা আইসিআই, বসুন্ধরা করে। এদের জন্যও মার্কেটে চালের দাম কিছুটা বাড়ে। তারা বাজারের চিকন চালের ধানটা পুরোটাই কিনে ফেলে। তাদের মিলে ক্রাশিং করে। যে চালটা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা খরচ পড়বে, সেটা তারা ৩ টাকা বা ৪ টাকা দিয়ে সুন্দর প্যাকেট করে ফেলে। সেই প্যাকেটে ৭০ টাকা, ৬৫ টাকা, ৮০ টাকা, ৮৫ টাকা দাম বললেও আপনারা কিনে নেন। ব্র্যান্ডের জন্য আপনারা মূল্য দেন।’
তিনি বলেন, ‘চাল কেটে সরু করার এ তথ্য কিন্তু ঠিক না। এটা দেখতে মিলে যেতে হবে। পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রথম ক্রাশিং থেকে শেষ ক্রাশিং এবং প্যাকেটজাত করা পর্যন্ত আপনাদের টিম কয়েকটা মিলে যেতে হবে। চাল কাটতে কাটতে কিন্তু ছোট করে না। ছোট করলে তার ওয়েট লস হবে, তার পোষাবে না।
‘পলিশ যেটা করে এতে কিন্তু ওজন কমে না। কিছুটা অংশ সুজিতে চলে যায়। মোটা চাল কেটে মিনিকেট বানানো এটা কিন্তু ঠিক না। আমাদের কিন্তু এটা ভুল ধারণা যে কেটে ছোট করে মিনিকেট বা মিনিকাট করে। ঘটনা কিন্তু তা নয়।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে বিষয় হলো, আগে দুই ছাঁটের চাল পাওয়া যেত। আমরা ঢেঁকিছাঁটা চাল খেতাম। আমি মনে করি, মানুষের বোধোদয় হয়েছে, যারা একটু প্রভাবশালী তারা লাল চাল খুঁজছে। এটা যদি অভ্যাস হয়ে যায় যে লাল চাল খাবে, তাহলে কিন্তু মিলারদের খরচটা বাঁচে, ভোক্তারও বাঁচে।
‘কিন্তু মানুষের অভ্যাস হয়েছে চকচকে চাল খাবে। এটা করতে গিয়ে মিনিমাম তিনটা ছাঁট দেয়। এরপর পলিশ দেয়। স্বর্ণকাররা যেমন গহনা তৈরি করার পর এই পলিশ ওই পলিশ দেয় রং চকচক করার জন্য, এটাও চকচক করে। এতে আর পুষ্টি থাকে না। এখন ব্র্যান্ড বন্ধ করবেন কীভাবে? অভ্যাসটা যদি পরিবর্তন হয়, চকচকে চাল না কেনে এবং দোছাঁটি চাল যদি আমরা কেনা শুরু করি, সবাই যদি লাল চাল কিনতে চায়, তখন এই মিলাররাই লাল চাল করবে। আর কিন্তু চকচক চাল তারা করবে না।’
মোটা চালের দাম বাড়েনি
বাজারে সরু চালের দাম বাড়লেও মোটা চালের দাম বাড়েনি বলে মন্তব্য করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘মোটা চালের দাম বাড়ছে বলে আমি মনে করি না। মানুষ সরু ও মাঝারি চাল খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সরু চাল কিন্তু আমনের সময় হয় না। এটা উৎপাদন হয় বোরো সিজনে। এ সময়ে প্রায় ৮০ শতাংশ সরু ও মাঝারিটা উৎপাদন হয়।
‘সরু চাল আমরা যেটা আমদানি করি, সেটা কিন্তু আমরা একেবারে শূন্য ট্যাক্সে আমদানি করি না। জিরো ট্যাক্সে করলে কিন্তু দাম কমে যাবে। ২৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটাও আমাদের চিন্তা করতে হবে।’
সবজির দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো নীতিমালা না থাকার কথাও স্বীকার করেন তিনি। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘উৎপাদিত ফসল যখন বাজারে আনা হয়, সবজির কথা বলছি, সবজি ঢাকায় আসতে আসতে যদি চার-পাঁচ গুণ দাম বেশি হয়, এটা কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো সিস্টেম নেই, মনিটরিংও নেই, নীতিমালাও নেই।
‘আমাদের কোনো রেটও নেই যে লালশাক এ দামে বিক্রি করতে হবে, কপি এ দামে বিক্রি করতে হবে। কৃষকরা যদি তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম না পান, তাহলে কিন্তু উৎপাদনই করবেন না। আমাদের কৃষকরা যে এখনও তৈরি করে আমাদের খাওয়াচ্ছেন, এটাও কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের যদি ১০ হাত বাই ১০ হাত জায়গাও থাকে, আমরা নিজেরাই যদি সবজি তৈরি করি, তাহলে কিন্তু চাহিদা অনেকটাই মিটে যায়।’
সম্প্রতি সবজির দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিকে দায়ী করেন তিনি।