বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার। ২০১৯ সালের এই দিনে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান বরেণ্য এই মানুষটি।
দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন বিপর্যস্ত। ১৯৭২ সালের গোড়ার দিককার কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসে ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটি শরণার্থী। তাদের জন্য জরুরিভাবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প ছিল না তখন।
ওই সময় লন্ডন ছেড়ে দেশে ফেরেন তরুণ ফজলে হাসান আবেদ। শরণার্থীদের সহায়তা দিতেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গড়ে তোলেন ‘ব্র্যাক’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়নই ছিল মূল লক্ষ্য।
১৯৩৬ সালে জন্ম নেন আবেদ। ১৯৬২ সালে লন্ডন থেকে হিসাববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সিনিয়র করপোরেট এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানিতে। কিন্তু ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় আর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দারুণভাবে আলোড়িত করে তাকে। জীবনে আসে নাটকীয় মোড়। চাকরি ছেড়ে তিনি চলে যান লন্ডনে। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন।
৫০ বছরের যাত্রায় তার হাতে গড়া ব্র্যাক এখন বিশ্বের এক নম্বর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় রূপ নিয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কর্মসূচি। প্রভাব, উদ্ভাবন এবং টেকসই বৈশিষ্ট্য- এসব বিষয় মাথায় রেখে জেনেভাভিত্তিক গণমাধ্যম সংগঠন ‘এনজিও অ্যাডভাইজার’ ২০১৯ সালে টানা চতুর্থবারের মতো ব্র্যাককে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ এনজিওর মধ্যে শীর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সামাজিক ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ ক্রাউন ২০০৯ সালে ‘দ্য মোস্ট ডিস্টিংগুইশড অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জ’ উপাধিতে ভূষিত করেন ফজলে হাসান আবেদকে।
২০১০ সালে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সহায়তায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে পরামর্শ প্রদানে নিযুক্ত ‘বিশ্বের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের’ তালিকায় ২০১০ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় তার নাম। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে ‘ফরচুন ম্যাগাজিন’-এর তালিকায় বিশ্বের ৫০ সেরা নেতার তালিকাতেও উঠে আসে স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম।
উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতির মধ্যে আছে শিক্ষা উন্নয়নে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ইদান প্রাইজ (২০১৯), নেদারল্যান্ডের রাজার রয়েল নাইটহুড উপাধি (২০১৯), লেগো অ্যাওয়ার্ড (২০১৮), লাউদাতে সি’ অ্যাওয়ার্ড (২০১৭), হোসে এডগারডো ক্যাম্পোস কোলাবোরেটিভ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, দক্ষিণ এশিয়া অল (২০১৬), টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ পুরস্কার (২০১৬), ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ (২০১৫)।
এ ছাড়া আছে ট্রাস্ট উইমেন হিরো অ্যাওয়ার্ড (২০১৪), অর্ডার অব সিভিল মেরিট (অর্ডেন ডেল মেরিটো সিভিল, ২০১৪), লেভ তলস্তয় স্বর্ণপদক (২০১৪), ওপেন সোসাইটি প্রাইজ (২০১৩), শিক্ষার জন্য ওয়াইজ প্রাইজ (২০১১), আন্ট্রপ্রেনর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড (২০০৯), ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), হেনরি আর. ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ (২০০৭), দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কর্তৃক আজীবন সম্মাননা (২০০৭), মানব উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনরশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইন্টারঅ্যাকশন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮), অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০), ইউনেসকো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং কমিউনিটি লিডারশিপের জন্য রামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড (১৯৮০)।
বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রিও দেয়া হয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। এগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’ (২০১৪), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লেটার্স’ (২০০৯), যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’ (২০০৮) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স’ (২০০৭)।