বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম শাওইল। গ্রামটিতে গেলে সার্বক্ষণিক মিলবে এক ছন্দে তাঁতের খটখট শব্দ।
শীতের শুরুতে গ্রামটির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই হয়ে পড়েন মহাব্যস্ত। কেউ সুতা ছাড়াচ্ছেন, কেউ চরকা নিয়ে বসে সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছেন, কেউ বা সুতা ববিন করছেন।
প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ও ঘরে বসানো পরিপাটি তাঁতযন্ত্রগুলো চলছে দিন-রাত। সব বাড়িতেই রয়েছে ১ থেকে ১০টি তাঁত। কোনোটা চাকাওয়ালা আবার কোনোটা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে হাতে তৈরি।
শীত শুরুর আগে থেকেই সেই তাঁতে বোনা শুরু হয় কম্বল ও বড় চাদর। অবিরাম ঘুরতে থাকা চরকাগুলোতে হয় উলের সুতা। এ ছাড়া বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ নানা বস্ত্র ও পোশাকও তৈরি করেন অনেকে।
শুধু শাওইল নয় দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলিঞ্জা, পুশিন্দা, দেওড়া, দত্তবাড়ীয়া, বিনাহালী, কেশরতাসহ আশপাশের প্রায় ২৫ গ্রামের চিত্র একই।
স্থানীয় লোকজন জানান, দেশের তাঁতশিল্পে বড় অবদান বগুড়ার শাওইল গ্রাম ও তার আশপাশের তাঁতিদের। উত্তরবঙ্গের এই তাঁতিগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে রেখেছে তাঁতের ঐতিহ্য। শীতের সময় মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে কয়েক গুণ।
শাওইল গ্রামসহ এখানকার ২৫ গ্রামে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার। এ শিল্পের ওপর জীবিকা নির্ভর করে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের।
শীতে এসব গ্রামে তৈরি হওয়া বস্ত্র বিক্রির জন্য এখানে গড়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী এক হাট। সেই হাট শুরু হয় ভোর ৪টা থেকে। চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত।
হাট যখন শুরু হয় দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন মেলা বসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীদের পদচারণে এ সময় মুখরিত থাকে হাট ও গ্রামগুলোর পথঘাট। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলে চাদর, কম্বল আর সুতা কেনার প্রতিযোগিতা।
পণ্য পরিবহনে হাটের চারপাশে থাকে শত শত ট্রাক, অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান।
প্রাচীনতা ও জনপ্রিয়তার জন্য এ হাটের আশপাশের গ্রামগুলোকে তাই বলা হয় ‘চাদর কম্বল হাটের গ্রাম’।
শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সভাপতি জইম উদ্দীন জানান, শাওইল হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার দোকান।
এখানকার চাদর খুব উন্নতমানের হওয়ায় চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। পৃথিবীর নানা দেশেও রপ্তানি হয়। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তা তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় এসব কম্বল ও চাদর।
তিনি আরও জানান, কোনো ধরনের প্রচার ও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র। চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরির যন্ত্র, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চাহিদা ভালো থাকায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কারিগর।
তাঁত পণ্য কেনাবেচায় হাটের দোকানগুলোতে রয়েছেন অন্তত আট হাজার শ্রমিক। তারা প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি ও তা সাজিয়ে রাখে। ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরিতে এসব কর্মচারীর অধিকাংশই আশপাশের গ্রামের নারীরা।
শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, শাওইলের চাদর আর কম্বল গ্রামগুলো ঘিরে হাজারও সম্ভাবনা থাকলেও সেভাবে বিষয়টি দেখা হচ্ছে না। তাঁতিদের সরকারি সুবিধা দিলে এটি হতে পারত রপ্তানির অন্যতম ক্ষেত্র।
সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়ে তিনি জানান, আদমদীঘি থেকে এই বাজারের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। এখানে কোনো ব্যাংক নেই। অর্থ লেনদেনের জন্য তাই যেতে হয় আদমদীঘি ও মুরইলে। শাওইল হাটের মতো ব্যবসাকেন্দ্রিক স্থানে ব্যাংক না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক।
তিনি আরও জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তাঁত বস্ত্রের চাহিদা নানা কারণে কমে গেলেও এখনও একেবারেই হারিয়ে যায়নি। তাঁতশিল্পীদের পর্যাপ্ত মূলধনের জোগানের পাশাপাশি পরিকল্পিত বাজারজাত ও ঠিকমতো কাঁচামাল সরবরাহ করলে এটি ফের জনপ্রিয় করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু একটু উদ্যোগ।