বিজয় দিবসের সঙ্গে সাপ্তাহিক দুই দিন মিলিয়ে টানা তিন দিনের ছুটিতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করেন প্রায় সাত হাজার পর্যটক। এই তিন দিন যানজট তৈরি হয় লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে চলার সড়কে। লাউড স্পিকারের আওয়াজে বনভূমির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকের সংখ্যা কমিয়ে আনার দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, ছোট এই বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিয়ন্ত্রিত পর্যটনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মাত্র তিন দিনে সাত হাজার পর্যটকের প্রবেশ আবার সামনে নিয়ে এসেছে এ দাবি।
বন বিভাগ বলছে, তারাও পর্যটক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কাজ করছে। শিগগিরই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যে কেউ চাইলেই প্রবেশ করতে পারবে না এ বনে। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সীমিতসংখ্যক পর্যটককে প্রবেশ করতে দেয়া হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ লাউয়াছড়া বনটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এই বনে উল্লুক, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বনমোরগ, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশূকর, অজগরসহ অনেক প্রজাতির বিরল, বিপন্ন ও বিপন্নপ্রায় প্রাণী আছে।
এখানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রকারের উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর এ বনের ভেতর পর্যটকরা আসতে শুরু করেন প্রকৃতি ও প্রাণীদের জীবন পর্যবেক্ষণ করতে। কিন্তু দিনে দিনে এটি একটি সাধারণ পর্যটন স্থানে রূপ নিয়েছে। অসচেতন পর্যটকরা বনের ভেতর ঢুকে প্লাস্টিকের আবর্জনা ফেলেন। চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। বন্যপ্রাণীদের ঢিল ছোড়েন।
লাউয়াছড়ার প্রধান যে ফটক, মূলত সেদিক দিয়েই পর্যটকরা প্রবেশ করেন এবং এই রাস্তা দিয়ে ভেতরে গিয়ে রেললাইনের পাশে একই জায়গায় জটলা করে চেঁচামেচি করেন, যা প্রাণীদের বিরক্ত করে। অনেকে আবার গাড়িতে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে লাউয়াছড়ার সড়কে ঘোরেন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন গবেষকরা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান জানান, ‘উচ্চৈশব্দ প্রাণীদের আতঙ্কিত করে। তাদের প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে। দুপুরবেলা বেশির ভাগ প্রাণী বিশ্রামে থাকে, সেই সময়ে শব্দ করলে তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, ফলে তাদের সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ে।’
এদিকে বনের ভেতর প্লাস্টিক ও নানা আবর্জনায় বিরক্ত আরেক গবেষক হাসান আল রাজি চয়ন। তিনি বলেন, ‘গবেষণার কাজে প্রায়ই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেতে হয়। কিন্তু যখন দেখি পর্যটকরা ময়লা ফেলছেন, চিৎকার করছেন, তখন খুব খারাপ লাগে। লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণীদের ঘর। তাদের ঘরে তাদের নিরাপদে থাকতে দিতে হবে। তাই পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। পর্যটকদের ধারণা নেই একটি কৃত্রিম পার্ক আর সংরক্ষিত বনের তফাতটা কী?’
তিনি লাউয়াছড়ার দ্রুত পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানান। একই সঙ্গে তিনি বন বিভাগকে একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট তৈরির বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের মাংসাশী প্রাণীবিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মুনতাসির আকাশ বলেন, ‘বাঘ ও চিতাবাঘ না থাকলেও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে নানা রকম মাংশাসী প্রাণী আছে। এর মাঝে চিতাবিড়াল, মেছোবিড়াল, সোনালি বিড়াল অন্যতম। ছোট এই বনে হাজার হাজার পর্যটক বনের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেখানে পর্যটকদের নীরবে প্রকৃতি উপভোগ করার কথা, সেখানে এত উচ্চৈঃস্বরে হই-হুল্লোড় প্রাণীদের অসুবিধার সৃষ্টি করে। অতিদ্রুত পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বিকাশে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
গবেষকদের দাবির পক্ষে বন বিভাগও। তারা জানিয়েছেন, দ্রুত তারা পর্যটক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, ‘আমরা গবেষক ও পরিবেশবাদীদের দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি। বেশি চিল্লাচিল্লিতে প্রাণীরা মানসিক অস্থিরতায় ভোগে, সেটা আমরা জানি। তাই একটি প্রাথমিক পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছি। প্রতিদিন এক হাজারের বেশি পর্যটক লাউয়াছড়ায় ঢুকতে পারবেন না। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে আসতে হবে। তবে স্থানীয়দের কথা বিবেচনা করে কিছু টিকিট কাউন্টারে রাখা হবে, যেন উপস্থিত সময়ে টিকিট কেটে ঢুকতে পারেন।
‘হয়তো এমন হতে পারে ৫০০ থাকল অনলাইনে, আর ৫০০ সরাসরি মূল ফটকে। এখন এটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ওপর মহল যাচাই-বাছাই করে দেখবে। তা গ্রহণযোগ্য মনে হলে তবেই এটা বাস্তবায়ন হবে।’