ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সার্জেন্ট মহুয়া হাজংয়ের বাবা মনোরঞ্জন হাজং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর মামলা না নেয়ার ঘটনায় তৈরি হয় ব্যাপক সমালোচনা।
অভিযোগ ওঠে, মনোরঞ্জনের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়া প্রাইভেট কারের চালক সাঈদ হাসানকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আটক করলেও বিচারপতির ছেলে হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার পর গত ১৬ ডিসেম্বর মহুয়ার মামলা গ্রহণ করে বনানী থানা। সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮ ও ১২৫ ধারায় এই মামলায় গাড়ির চালকসহ অজ্ঞাতপরিচয় তিনজনকে আসামি করা হয়।
এর পর পরই জানা যায়, মহুয়া মামলা করার দুদিন আগে তার বাবার বিরুদ্ধেই একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ওই বিচারপতির ছেলে। এই জিডি নিয়েও চলছে সমালোচনা।
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যানবাড়ি ইউলুপে গত ২ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। কীভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটল, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা, রাস্তার ইউলুপের অবস্থান বিশ্লেষণ এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেই রাতে ইউলুপে উল্টোপথে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করেন মনোরঞ্জন হাজং। থেমে থেমে তিনি এগোনোর সময় ইউলুপের নির্ধারিত দিক থেকে ঢোকা সাঈদ হাসানের বিএমডব্লিউ প্রাইভেট কারটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে মারাত্মক আহত হন মনোরঞ্জন।
বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যানবাড়ি ইউলুপে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত সদস্য মনোরঞ্জনকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তির পর তার বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এরপর অবস্থা অবনতি হলে নেয়া হয় বারডেম হাসপাতালে। সেখানে তিনি এখন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বিএমডব্লিউ প্রাইভেট কারটিতে চালকের আসনে ছিলেন বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাঈদ হাসান। গাড়িটিতে আরও ছিলেন সাঈদ হাসানের স্ত্রী অন্তরা সাঈদ ও রোয়াদ রহমান নামে একজন।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দর সড়কের চেয়ারম্যানবাড়িসংলগ্ন এলাকায় দুটি ইউলুপ রয়েছে। প্রথমটি দিয়ে মহাখালী থেকে আসা গাড়িগুলো ঘুরে আবার মহাখালীর দিকে যেতে পারে। এর কয়েক শ গজ দূরের দ্বিতীয় ইউটার্ন দিয়ে বনানী থেকে আসা গাড়িগুলো ঘুরে আবার বনানী বা বিমানবন্দরের দিকে যায়।
বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িসংলগ্ন রাস্তার এই ইউলুপে দুর্ঘটনাটি ঘটে২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে দুর্ঘটনাটি ঘটে দ্বিতীয় ইউটার্নে, যেটি দিয়ে বনানীর দিক থেকে আসা গাড়িগুলো ঘুরে ফের বনানীর দিকে যেতে পারে।
এ ঘটনায় বনানী থানায় মহুয়া যে মামলা করেছেন, সেখানে তিনি বলেন, তার বাবা মহাখালীর দিক থেকে চেয়ারম্যানবাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এই অভিমুখে চলাচলকারী যানবাহনের ইউটার্ন নিতে আলোচিত ইউলুপটি ব্যবহার করার কথা নয়। তবে দুর্ঘটনার পর মনোরঞ্জনের মোটরসাইকেলটি সেখান থেকেই উদ্ধার করে পুলিশ।
রোববার ওই ইউলুপে গিয়ে দেখা যায়, এর উল্টো দিক দিয়ে ঢোকার পর বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে ডান পাশে মনোরঞ্জনের মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনায় পড়ার চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। সড়ক ডিভাইডারে রয়েছে ঘষা খাওয়ার দাগ।
ঘটনাস্থলের চিত্র বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, বিচারপতি রেজাউল হাসানের ছেলে সাঈদ হাসানের গাড়ি বনানীর দিক থেকে এসে ওই ইউলুপের বাম লেন ব্যবহার করে ইউটার্ন নিচ্ছিল। এ সময় উল্টোদিক থেকে আসা মোটরসাইকেলের সঙ্গে গাড়িটির সংঘর্ষ হয়।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, রাত ২টার দিকে উল্টোপথে ইউলুপে একটি মোটরসাইকেল প্রবেশ করে। এটি চালাচ্ছিলেন মনোরঞ্জন হাজং। তিনি থেমে থেমে সামনে এগোচ্ছিলেন।
মোটরসাইকেলটি ইউলুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছু আগে উত্তর দিক দিয়ে ছুটে আসা প্রাইভেট কার বাম পাশ থেকে ধাক্কা দেয়।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা গাড়িটি লাল রঙের বিএমডব্লিউ, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫৪৯০৬। ঘটনার পর ধারণ করা অন্য একটি ভিডিওতে বনানী থানা পুলিশের এক সদস্যকে প্রাইভেট কারের চালকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর পরই বনানী থানা পুলিশ গাড়ির চালক ও অন্য দুই যাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তখনই জানতে পারি চালক একজন বিচারপতির ছেলে। এরপর ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশে আটক চালককে ছেড়ে দেয়া হয়।’
দুর্ঘটনার ১৪ দিন পর বনানী থানা ‘অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের’ বিরুদ্ধে মহুয়ার মামলা গ্রহণ করে। তবে মনোরঞ্জন হাজংয়ের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তারা প্রথমে যে মামলার আবেদন করেছিলেন, সেখানে তিনজনের নাম উল্লেখ ছিল।
মামলা নিতে এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে ডিএমপির উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরই আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তবে যাচাই করার প্রয়োজন ছিল। আমরা যাচাই-বাছাই করে মামলা নিয়েছি।’
যাচাই করে কী পাওয়া গেছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করেছি। মধ্যরাতে মনোরঞ্জন হাজং মোটরসাইকেলে উল্টোপথে এসে চেয়ারম্যানবাড়ি ইউলুপের ওখানে দাঁড়ান। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় একটি গাড়ি ধাক্কা দেয়। আমরা মামলা নিয়েছি।’
বাবা মনোরঞ্জন হাজংয়ের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট মহুয়া হাজং। ছবি: সংগৃহীতগাড়ির আরোহীদের পরিচয় জানার পরও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নাম না থাকলেও সমস্যা নেই। তদন্তে সবই উঠে আসবে।’
অন্যদিকে মহুয়ার মামলা নেয়ার দুদিন আগে (১৪ ডিসেম্বর) বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন বিএমডব্লিউ গাড়িটির চালকের আসনে থাকা সাঈদ হাসান। এর তদন্ত করছেন বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর গাজী।
দুর্ঘটনার বিষয়ে বিচারপতির ছেলে সাঈদ হাসানের কোনো বক্তব্য নিতে পারেনি নিউজবাংলা। তবে সাঈদ হাসান সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, তিনি ২ ডিসেম্বর রাতে চেয়ারম্যানবাড়ির ইউলুপে ঢোকার পর উল্টো দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেল সামনে পড়ে যায়। মোটরসাইকেলটি তার গাড়ির বনেটের বাম পাশের হেডলাইট বরাবর ধাক্কা খায়। এই দুর্ঘটনার ফলে বিএমডব্লিউ গাড়িটি ইউলুপের প্রাচীরে লেগে যায়।
জিডিতে সাঈদ লেখেন, ‘আমার গাড়িটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়নি বা পেছন থেকে ধাক্কা দেয়নি। বেআইনিভাবে উল্টো দিক থেকে ইউলুপে ঢুকে মোটরসাইকেলের আরোহী বরং আমার গাড়ির বাম পাশের হেডলাইট বরাবর লাগিয়ে দেন। এতে আমি প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হই।’
তিনি সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, দুর্ঘটনার পর সার্জেন্ট মহুয়ার বাবা মনোরঞ্জন হাজংয়ের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। একাধিকবার আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন।
তিনি বলেন, ‘গাড়িটি বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে আমরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। আমি ও আমার স্ত্রী এই ঘটনার ভিকটিম। কেবল প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কারণে এর দায় আমার নয়।’