সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার জয়াখালী গ্রামের ৪০ বছর বয়সী রহিমা বেগম প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, সঙ্গে রক্তস্রাব ও সাদাস্রাবে ভুগছিলেন। মাস সাতেক আগে চিকিৎসার জন্য যান উপজেলা সদরে ডা. সুজিত রায়ের কাছে। তিনি সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার; কিন্তু নিয়মিত রোগী দেখেন বেসরকারি চেম্বারে আর চুক্তিতে অস্ত্রোপচার করেন স্থানীয় ‘সুন্দরবন অ্যাপোলো হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ। রোগীর অবস্থা দেখে-শুনে ওই দিনই তিনি জানিয়ে দেন, রহিমার একটি অঙ্গ অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে।
দুশ্চিন্তায় পড়ে যান রহিমা। পরে আরেক ক্লিনিকে গিয়ে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে তার ওষুধ খেয়ে কিছুদিন ভালো থাকেন। কিন্তু করোনাকালের নানা সমস্যায় পড়ে সেই ডাক্তারের কাছে আর যেতে না পেরে আবারও যান ডা. সুজিতের কাছে।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর রহিমা বেগম বলেন, ‘ডাক্তার তখন বেশ রাগ করেন- কেন আমি তার পরামর্শমতো অপারেশন করাইনি।’
ডাক্তারের ধমক খেয়ে স্বামীকে নিয়ে রহিমা এবার গেলেন এলাকার ‘বড় ডাক্তার’ বলে পরিচিত সুন্দরবন অ্যাপোলো ক্লিনিকেরই মালিক মো. শাহজাহান সিরাজের কাছে। সব শুনে তিনিও বলে দেন, অপারেশনই একমাত্র সমাধান। কিন্তু মন সায় দেয় না কিছুতে। আরও যাচাইয়ের জন্য স্বামী-স্ত্রী গেলেন অ্যাপোলো হাসপাতালেরই ডা. শেখ আরাফাতের কাছে। তিনি আবার রহিমাকে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন।
এভাবে চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে শেষমেশ এই দম্পতি ‘এলাকার ছেলে শাহজাহান ডাক্তার’-এর ওপর ভরসা করে অপারেশনেই রাজি হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন অ্যাপোলোর ওটিতে ডা. সুজিত রায় নিজ হাতে অপারেশন করে রহিমার দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ কেটে ফেলে দেন।
আরেক ঘটনা শ্যামনগরেরই কৈখালী গ্রামের খাদিজা বেগমের। উপকূলবাসী এই নারীর সমস্যা ছিল অনিয়মিত পিরিয়ড এবং তলপেটে ব্যথা। চিকিৎসার জন্য স্থানীয় এমআরএ ক্লিনিকে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ডা. আনিছুর রহমানকে দেখাতে গেলে তিনিও খাদিজার একটি অঙ্গ ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন। গত ২৮ আগস্ট ওই বেসরকারি ক্লিনিকের ওটিতে নিয়ে ৩২ বছর বয়সী খাদিজা বেগমের শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি কেটে বাদ দেন সরকারি চিকিৎসক আনিছুর রহমান।
- নোনা পানিতে রোগাক্রান্ত জরায়ু চিকিৎসা ছাড়াই কেটে বাদ
- উপকূলবাসী নারীরা নীতিহীন ডাক্তার-হাসপাতালের কাছে অসহায়
- মানবাধিকার লঙ্ঘন, ফৌজদারি অপরাধ আখ্যা দিয়ে শাস্তি দাবি
এই দুই বয়সের দুই নারীর দেহ থেকে যে অঙ্গটি অবলীলায় কেটে ফেলা হলো, সেটি সাধারণ অঙ্গ নয়; মানুষ যেখানে জন্ম নেয় সেই মাতৃগর্ভ; যাকে বলা হয় জরায়ু। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। সারাটা বছর তাদেরকে নোনা পানির সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে; বিশেষ করে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে। কিন্তু মানবপ্রজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি রোগাক্রান্ত হলে কোনো রকম চিকিৎসার উদ্যোগ না নিয়ে সরাসরি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন এ অঞ্চলের এক শ্রেণির চিকিৎসক।
শ্যামনগরে গত ৬ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ১৫ দিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ‘টাকার লোভে’ চিকিৎসক আর তাদের সহযোগী হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকেরা এমন কাজ করে চলেছেন। বিশিষ্ট নাগরিক ও আইন বিশেষজ্ঞরা একে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ বলে অভিহিত করেছেন।
উপকূলের নারীরা একদিকে নোনা পানির প্রভাবে চর্ম ও জরায়ুসংক্রান্ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন; অন্যদিকে আবার সেই রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অকালে জরায়ু খুইয়ে সন্তানধারণের ক্ষমতা হারাচ্ছেন। এখানেই শেষ হচ্ছে না তাদের দুর্বিষহ জীবনগাথা; এরপর শুরু হচ্ছে নানামুখী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ানক যন্ত্রণা, যা বাকি জীবন একাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই নারীদের।
সরেজমিন অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রহিমা-খাদিজা-ফিরোজার মতো নানা বয়সী নারীরা অহরহ শিকার হচ্ছেন এ রকম ‘অপচিকিৎসা’র। চিকিৎসাশাস্ত্রে জরায়ু অপসারণকে বলা হয় হিস্টেরেক্টমি। এই অপারেশন করা হয়েছে- এমন অন্তত ৭৫ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সবার বেলায়ই সংশ্লিষ্ট ‘ডাক্তার’ অন্য কোনো চিকিৎসা না দিয়ে সরাসরি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হিস্টেরেক্টমির বা জরায়ু কেটে ফেলার।
ধর মুরগি, কর জবাই!
অনুসন্ধানে এমন সব ঘটনার কথা জানা যায়, সেগুলো যেন চিকিৎসার নামে ‘ধর মুরগি, কর জবাই’। বছর চারেক আগের ঘটনা। খাদিজার মতো লক্ষণ নিয়ে গ্রাম্য ডাক্তারের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান শ্যামনগরের বৈশখালী গ্রামের ফিরোজা বেগম। জরায়ুতে ‘ঘা হয়েছে’ জানিয়ে তা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। পরে রিপোর্ট দেখে গ্রাম্য ডাক্তারও একই পরামর্শ দেন। দিশেহারা ফিরোজা তখন এক দালালের মাধ্যমে গিয়ে ভর্তি হন উপজেলা সদরের সেবা ক্লিনিকে। সেখানে এক রাতে কলে এসে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. কবিরুল ইসলাম কবির নিজের হাতে মাত্র ২৬ বছর বয়সী মেয়েটির জরায়ু কেটে ফেলে দেন।
ফিরোজা ও তার স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, ডাক্তার কবির এই রোগীকে কখনও দেখেনইনি। প্রথমে ক্লিনিকের পক্ষ থেকে কয়েকটি টেস্ট করানো হয়। পরে ক্লিনিকে এসে সেই রিপোর্ট দেখেই ফিরোজাকে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেন ডা. কবির।
জানা গেল, একই গ্রাম্য ডাক্তারের পরামর্শে ওই সেবা ক্লিনিকেই সেই কবির ডাক্তারের কাছে গিয়ে ফিরোজার বাড়ির আরেক নারী রোমেছা বেগমও (৩৫) জরায়ু অপসারণ করান কয়েক বছর আগে।
জানতে চাইলে গত ৬ ডিসেম্বর ডা. কবিরুল ইসলাম কবির অকপটে স্বীকার করেন ‘ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় রোগী বা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই’ অপারেশন করার কথা।
তিনি বলেন, ‘শুধু আমি একা না, প্রতিটি সার্জনই এই রকম পরিস্থিতির শিকার হন। আমরা তো সাতক্ষীরা থেকে সপ্তাহে একদিন অ্যানেসথেশিয়া টিম নিয়ে শ্যামনগরে যাই। আমার হয়তো ৫-৭টা অপারেশন থাকে। এর মধ্যে হয়তো ২-১টা রোগী আমার দেখা থাকে না।’
- ডা. কবিরসহ রহিমা ও খাদিজার জরায়ু অপসারণকারী দুই চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার পড়ুন ‘জরায়ু কর্তনকারী সেই ডাক্তাররা যা বলছেন’ শিরোনামের পার্শ্বপ্রতিবেদনে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রয়োজনে জরায়ু কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত ডাক্তাররা নিতেই পারেন; কিন্তু তার আগে কয়েকটি ধাপে রোগীর চিকিৎসা করাতে হবে।
হিস্টেরেক্টমি করা হয়েছে- শ্যামনগরের এমন অন্তত ১০ জন রোগীর চিকিৎসাপত্র ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট ঢাকার তিনজন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেলের দুইজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। ১০ জনের ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞরা মত দেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হিস্টেরেক্টমির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখনই হিস্টেরেক্টমি করে ফেলার মতো লক্ষণ কোনো রোগীরই ছিল না। বরং আরও কিছুদিন চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের অসুখটা সারানো যেত।
অথচ অনুসন্ধানকালে ওই ১০ জন রোগীর সবাই বলেছেন, ডাক্তারের কাছে গেলে তাদের কাউকেই ওষুধপত্রের মাধ্যমে চিকিৎসার কথা বলা হয়নি; বরং তাদের অসুখ অনিরাময়যোগ্য- এমনটি বুঝিয়ে জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারপর তারা সেই ডাক্তার অথবা দালালদের দেখানো ক্লিনিকে গিয়ে অপারেশন করিয়ে নিয়েছেন। শ্যামনগরে ১৩টির মধ্যে সাতটি ক্লিনিকেই খোঁজ নিয়ে এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরায়ু ফেলতে আসা প্রতিটি রোগীকেই তারা অপারেশন করেছেন, কাউকেই ফেরাননি।
শ্যামনগরের খাদিজা বেগমের আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন ডা. ইশরাত জাহান স্বর্ণার কাছে মেইল পাঠিয়ে তাকে জানানো হয়, স্থানীয় চিকিৎসক এই রোগীর জরায়ু কেটে ফেলতে বলেছেন। রোগী সেটা করবেন কি না, পরামর্শ চাইছেন। ডা. স্বর্ণা রিপোর্ট দেখে গত ১৩ অক্টোবর বলেন, ‘রিপোর্টে যে টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। খাদিজার রোগের ইতিহাস পিআইডির (পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ) লক্ষণের সঙ্গে কিছুটা মিললেও, সেটা একিউট কন্ডিশনের নয়। আর এমন রোগীর জরায়ু কেটে ফেলা কোনোভাবেই উচিত নয়।’
পরে ডা. স্বর্ণাকে যখন জানানো হয় যে, স্থানীয় ডাক্তাররা ইতোমধ্যে খাদিজার জরায়ু কেটে বাদ দিয়েছেন এবং ক্লিনিকের ছাড়পত্রে তার অসুখের নাম বলা হয়েছে পিআইডি, তখন তিনি বলেন, ‘পিআইডি যদি একিউট কন্ডিশনে থাকে অর্থাৎ রোগীর সবগুলো সিম্পটম যদি অতি তীব্র হয়, তাহলে গাইনি রোগ সংক্রান্ত জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী ওষুধের মাধ্যমেও চিকিৎসা আছে। এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে একিউট লেভেলের পিআইডি ভালো হয়ে যায়। তবে ওষুধের সঙ্গে রোগীকে কিছু নিয়ম মানতে হয়।’
আবার ক্রনিক কন্ডিশনের ক্ষেত্রেও ওষুধের রেজিম আছে। তারপরেও যদি রোগী ভালো না হয়, তখন হিস্টেরেক্টমির (জরায়ু কেটে ফেলা) অপশন আসে। তবে সেক্ষেত্রেও কিছু প্রটোকল রয়েছে- বলেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. স্বর্ণা বলেন, ‘আমাদের গাইডলাইনে পিআইডির ক্ষেত্রে হিস্টেরেক্টমি করার কথা বলা আছে তবে সেটাও অনেক জাজমেন্টের পরে। পিআইডির লক্ষণ পেলাম আর হিস্টেরেক্টমি করলাম, সেটা ঠিক নয়।’
তার মতে, ‘জরায়ু কাটার ক্ষেত্রে রোগীর বয়স বড় বিবেচ্য বিষয়। ৪৫ বছরের নিচে কোনো নারীর জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেললে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ।’
একইভাবে রহিমা বেগমের অস্ত্রোপচারপূর্ব রিপোর্ট ময়মনসিংহ মেডিক্যালেরই আরেক চিকিৎসককে পাঠিয়ে তার হিস্টেরেক্টমি জরুরি কি না, জানতে চাওয়া হয়। রহিমার রোগের পুরো হিস্ট্রি জেনে তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই নয়। তবে রোগীর সার্ভিক্যাল ক্যান্সার আছে কি না জানতে ভিআইএ (Visual Inspection of the cervix with Acetic acid) পরীক্ষা ও চিকিৎসা শুরু করা দরকার।’
পরে প্রকৃত ঘটনা জানানো হলে এই চিকিৎসক বলেন, ‘এই রোগীর জরায়ু কেটে ফেলা উচিত হয়নি।’ তবে তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
রহিমা বেগমের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, অপারেশনের আগে তার রক্তের গ্রুপ, আল্ট্রাসনোগ্রাম, হিমোগ্লোবিন, আরবিএস, ক্রিটিনিন, এইচবিএসএজি-আইসিটি পরীক্ষা করা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জরায়ু অপসারণের আগে এগুলোর সঙ্গে সিবিসি, ইউআরই, ইসিজি, পেলভিক অর্গানের আল্ট্রাসনোগ্রাম, টিভিএস, ভিআইএ পরীক্ষা করাতেই হবে। আর হিমোগ্লোবিন কমপক্ষে ১১ না থাকলে জরায়ু অপারেশন না করাই ভালো। কারণ, এই অপারেশনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তবে খুব জরুরি হলে রক্তের ব্যবস্থা রেখে অপারেশন করা যেতে পারে।
জানা গেল, রহিমা বেগমের রক্তে হিমোগ্লোবিন ছিল ৮.৪। অপারেশনের সময় পাঁচ ব্যাগ রক্ত লেগেছে তার। আগের আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে এবং হাসপাতালের ছাড়পত্রে দুই জায়গাতেই তার অসুখের নাম বলা হয়েছে, মাইল্ড বাল্কি ইউটেরাস (ঈষৎ ভারী জরায়ু)।
দেশের উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে সুইডেনে আছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. তাসনুভা আফরিন। অনলাইনে রহিমার নথিপত্র পাঠালে সব দেখে তিনি মন্তব্য করেন, ‘জরায়ু কাটার সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে রোগীর টিভিএস (ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড) এবং ভিআইএ টেস্ট অবশ্যই করাতে হবে। তার জরায়ু ভারী বলছে কেন, সেটা জানতে হবে। সেটা কোনো টিউমার কি না, টিভিএস ছাড়া বোঝা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রক্তক্ষরণ, ব্যথা, টিউমারের মতো জরায়ুর যেকোনো সমস্যায় দীর্ঘ সময় ধরে ভুগলে হিস্টেরেক্টমি করা যায়। কিন্তু এসব সমস্যার সবগুলোরই ওষুধে চিকিৎসা আছে এবং সেটা করে দেখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পুরো জরায়ু না কেটে আক্রান্ত স্থানটুকু শুধু অপারেশন করে বাদ দেয়া যায়।
‘তবে ওষুধে কোনোভাবেই কাজ না হলে অথবা জরায়ু ক্যান্সারে রূপ নিতে যাচ্ছে- এমন অবস্থা হলে হিস্টেরেক্টমি করা যায়। তবু তার আগে কমপক্ষে টিভিএস এবং ভিআইএ পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কোনো ক্লিনিকেই এই চর্চা নেই।’
জানতে চাইলে অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি (ওজিএসবি), বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম বলেন, ‘পিআইডির কিংবা জরায়ুর যেকোনো ধরনের সংক্রমণের তীব্রতার মাত্রা আছে। পিআইডি একজন কিশোরীরও থাকতে পারে। তাই শুধু একটা আল্ট্রাসোনো করেই জরায়ু কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।’
টাকার লোভেই অমানবিকতা!
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বললেন, ‘দুই বছর আগে এখানে এসে দেখেছি, ২২-২৩ বছর বয়সী মেয়েদের জরায়ু কেটে ফেলেছে। খুব খারাপ লাগতো। অনেক দিন ধরে ব্লিডিং হওয়া মানে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে, এটা ঠিক না- এই কথাটা তাদেরকে বলার কেউ ছিল না।’
তিনি বলেন, “পিল অনিয়মিত খাওয়ার কারণে হরমোনাল ইমব্যালেন্সে মাসিক অনিয়মিত হয়ে গেছে- এমন লক্ষণ নিয়ে রোগী কোনো সার্জনের কাছে গেলে, জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আবার অল্প বয়সে বিয়ে হয় বলে কম বয়সেই এখানকার মেয়েদের একাধিক সন্তান হয়। তখন ‘ফ্যামিলি কমপ্লিট’ যুক্তি দেখিয়ে জরায়ু কেটে ফেলেন অনেক সার্জন বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।”
কেন এমন অবলীলায় জরায়ু কেটে ফেলছেন- সে প্রশ্নের জবাব কেউ সরাসরি দিতে চান না। তবে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এর নেপথ্যে রয়েছে টাকার লোভ। জরায়ু অপারেশন বাবদ রহিমা বেগমকে সুন্দরবন অ্যাপোলো হসপিটালে পরিশোধ করতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা। ওষুধপত্র কেনার খরচ আলাদা। সব মিলিয়ে এই অপারেশন বাবদ তার প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
আর খাদিজার স্বামী মো. ইব্রাহিম জানান, স্ত্রীর জরায়ু অপারেশনের পর থেকে এ পর্যন্ত তার ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এর মধ্যে এমআরএ ক্লিনিককে দিতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা; সেখানে ১১ দিন থাকাকালে ওষুধ কিনতে হয়েছে ১১ হাজার টাকার। এখনও ওষুধপত্র লাগছেই।
শ্যামনগরের মতো উপকূলীয় এলাকার বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলো আয়ের জন্য যে অস্ত্রোপচারের দিকেই তাকিয়ে থাকে, তার সাক্ষ্য মেলে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াতের কথায়। তিনি বলেন, ক্লিনিকগুলো আসলে বাণিজ্যিক কারণেই বানানো হয়ে থাকে। তাদের সিংহভাগ আয় আসে গাইনি ও অবস্টেটিকস থেকে।
তিনি বলেন, ‘এর আগে ক্লিনিক মালিকদের সঙ্গে একটি মিটিংয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমি বলেছিলাম, আপনারা সিজারের রোগীদেরকে সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবেন। তখন তারা প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, তাহলে অর্ধেকের বেশি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাবে।’
- সাতক্ষীরার সিভিল সার্জনের পুরো সাক্ষাৎকার পড়ুন ‘নির্বিচারে জরায়ু কর্তন: ডাক্তারদের ধরার আইন নেই’ শিরোনামের পার্শ্বপ্রতিবেদনে।
বিভিন্ন ক্লিনিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরায়ু অপারেশনপ্রতি ডাক্তারদেরকে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়।
সিভিল সার্জনের হিসাবে- শ্যামনগরে নিবন্ধিত ও নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী ক্লিনিক-ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে ৯টি আর শুধু ডায়গনস্টিক সেন্টার আছে পাঁচটি। তবে এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর বাইরেও আরও অনেক ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। নিবন্ধিত হোক আর অনিবন্ধিত হোক, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসেবার মানে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি।
নগর প্রাইভেট হাসপাতালের কর্ণধার হাফিজুর রহমান জানান, তার ক্লিনিকটিতে মাসে ৩০-৩৫টি অপারেশন করা হয়। এর মধ্যে জরায়ু অপারেশন হয় ২-৩টি।
সুন্দরবন অ্যাপোলা হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা যামিনী রায় জানান, গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে ১২ জনের হিস্টেরেক্টমি করা হয়েছে। আর শুধু অক্টোবর মাসে অপারেশন হয়েছে মোট ৭৯ জনের, এর মধ্যে জরায়ু কাটার অপারেশন তিনটি।
রহিমা ও খাদিজার খরচের হিসাবকে গড় ধরলে গত ১৭ জানুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবন অ্যাপোলা হসপিটাল শুধু জরায়ু অপসারণ করেই প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করেছে। এর সঙ্গে রোগীদের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেও তাদের আয় যথেষ্ট। করোনা মহামারি না থাকলে এই আয় যে আরও অনেক বেশি হতো, তা ক্লিনিকগুলোর কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন।
নগর প্রাইভেট হাসপাতালের কর্ণধার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০২০ সালে মাত্র ৪০ জন রোগীর হিস্টেরেক্টমি করানো হয়। করোনার কারণে গত বছর থেকে শুধু সিজারের মতো জরুরি অপারেশনগুলোই বেশি করা হয়।’
অথচ সঠিক চিকিৎসা দিলে যে এসব রোগী জরায়ু কাটার অভিশাপ থেকে রেহাই পেতেন, সে উদাহরণও উঠে আসে অনুসন্ধানে। বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়মিত রক্তপাত আর তলপেটে ব্যথায় ভুগতে থাকা মাজেদা বেগম মর্জিনার (৩৫) একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর পর জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দেন একজন গ্রাম্য ডাক্তার। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন মর্জিনা। যোগাযোগ হয়েছিল একটি ক্লিনিকের দালালের সঙ্গেও। এরই মাঝে এক স্বজনের পরামর্শে শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে যান তিনি। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার একজন চিকিৎসক মর্জিনাকে ১৫ দিনের ওষুধ দেন এবং বলে দেন যে, কোনো অবস্থাতেই তার জরায়ু অপসারণের দরকার নেই।
গত ২৩ নভেম্বর যোগাযোগ করা হলে মর্জিনা এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি এখন ভালো আছেন।
আরেক ভালো দৃষ্টান্ত মেলে শ্যামনগরের বিদেশি সহায়তায় পরিচালিত ‘ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’-এ। ২০২০ সালে জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে প্রায় ৪০০ নারীর ভিআইএ করা হয়। এদের মধ্যে ৬৭ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি পাওয়া যায়। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের খুলনা ও ঢাকায় রেফার করা হয়। বাকি সবাইকে ওষুধপত্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়েই ভালো রাখা হয়। কারও জরায়ু কেটে ফেলতে হয়নি।
এসব ঘটনার কথা জানালে মানবাধিকার-কর্মী ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘নারীকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে এই জরায়ু। অথচ সামান্য কটা টাকার লোভে অসাধু ডাক্তার-ক্লিনিক-হাসপাতাল চক্র কোনো রকম চিকিৎসা-উদ্যোগ ছাড়াই নারীদের জরায়ু কেটে চলেছে, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। যারা এসব করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’
বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে অযথা অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলা হলে সেটি একজন নারীর জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি; নারীত্বের জন্য চরম দুর্ঘটনা। দেশের বিভিন্ন উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে গজিয়ে ওঠা শত শত ক্লিনিকের কিছু কিছু চিকিৎসক আছেন, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেন; আবার অনেকের অবহেলাও রয়েছে। এসব ডাক্তারের বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) আবেদন করে লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা করা যতে পারে; আবার ফৌজদারি মামলাও করা যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারও রাখেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ এত কিছু জানেন না। আবার এতো প্রতিকূলতার মধ্যে আইনি যুদ্ধ করার শক্তিও তাদের নেই। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা বা সামাজিক সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।’
অযাচিতভাবে জরায়ু কেটে ফেলা মানবাধিকার লঙ্ঘন মন্তব্য করে এই আইনজ্ঞ বলেন, ‘একজন নারীর জরায়ু যদি সেরকম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে অপসারণের প্রয়োজন না হয়; তাহলে বেঁচে থাকার অধিকারের মতোই নারীর অধিকার আছে তার জরায়ু সংরক্ষণ করার।’
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দুর্বিষহ জীবন
জরায়ু কাটলেই যে নারীরা ভালো থাকছেন, তাও নয়। কথা বলে জানা যায়, নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত ৪ নভেম্বর দুই সন্তানের মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘আগে তো মাসের কিছুদিন শুধু পেটে ব্যথা করতো। অপারেশনের পর এখন সারাক্ষণ গা দিয়ে দাহ ওঠে। কাটা জায়গায় জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মনে হয়, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, তাহলে একটু আরাম পাব।’
জরায়ু অপারেশনের পর থেকেই প্রচণ্ড রকম মাথা ও শরীর জ্বালায় ভুগছেন বলে জানান ৩০ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম। এমনকি স্বামীর সঙ্গও ভালো লাগে না। সংসারেও অশান্তি লেগে থাকে সারাক্ষণ। সংসার টেকানো দায় হয়ে গেছে।
ফিরোজা বলেন, ‘এমন সমস্যা হবে জানলে আমি অপারেশন করতামই না।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যালের ডা. ইশরাত জাহান স্বর্ণা বলেন, ‘মেয়েদের শরীরে আলাদা হরমোন আছে, যা দিয়ে মাসিক চক্র, মেজাজ, স্মৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু জরায়ু কেটে ফেললে এসব হরমোনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। জরায়ুর সঙ্গে আবার ওভারি কেটে ফেললে এসব হরমোনের সোর্স নষ্ট হয়ে যায়।
‘ফলে একজন অল্পবয়সী রোগী যার মেনোপেজ হওয়ার কথা ছিল না, তার জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেললে ভয়াবহ সব সিম্পটম হবে। তার তীব্র গরম লাগবে, মনে হবে মরে যাচ্ছে। তার ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হবে অর্থাৎ মাসিকের রাস্তা শুকনো হয়ে যাবে, ফলে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না; কষ্ট হবে। তার হাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে। সার্বিক ভালোলাগা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে বলা হয়, হিস্টেরেক্টমি ডিম্বাশয়ের রক্ত সরবরাহ এবং কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বলেন, ‘অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেললে নারীদের হট ফ্লাস (হাত-পা ও শরীর জ্বালাপোড়া), অল্পতে মেজাজ উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতেই থাকে।’
প্রায় সব রোগী জানিয়েছেন, জরায়ু কেটে ফেলার পর চিকিৎসকরা জ্বালাপোড়া কমাতে আজীবনের জন্য ‘টিবোনর’ ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকরাও জানান, নারীদের মেনোপজ-পরবর্তী বা অস্ত্রোপচারের ফলে মেনোপজের উপসর্গের চিকিৎসায় এই ট্যাবলেট দেয়া হয়।
তবে বেশির ভাগ রোগীই বলেছেন, এক পাতা (১০টি ট্যাবলেট) টিবোনর কিনতে প্রায় ২০০ টাকা লাগে। যেখানে অভাব সবার নিত্যসঙ্গী, সেখানে সারা জীবন এই ওষুধ কিনে খাওয়া কি সম্ভব?