বিজয়ের ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অর্জন একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত সৃষ্টি। সরকারি চেষ্টা ও নানা রকম নীতি সহায়তার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠা এই বেসরকারি খাতের জাদুকরী ছোঁয়াতেই মূলত পাল্টে গেছে অর্থনীতির চেহারা।
দেশ পুনর্গঠনের সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের হাতে কৃষিভিত্তিক পণ্য পাট, চা ও চামড়া ছাড়া দেশীয় অবলম্বন বলতে আর তেমন কিছুই ছিল না। ওই সময় মোটা দাগে এই কয়টি পণ্যই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল উৎস। এর বাইরে ৫৫ হাজার বর্গমাইলজুড়ে যে উৎপাদন হতো, তখনকার ৭ কোটি মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা তা দিয়ে পূরণ হতো না।
সময় বদলেছে। প্রান্তিক কৃষকের সনাতনি সেই কৃষিতে লেগেছে বেসরকারি খাতের ছোঁয়া। কৃষির আরও সম্প্রসারণ, আধুনিকীকরণ এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতেও বেসরকারি খাত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এতে করে ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত খাদ্য রপ্তানি হচ্ছে।
শুধু কৃষিই নয়, বেসরকারি খাতের জাদুকরীপ্রভাব পড়েছে শিল্প খাতেও। এর ওপর ভর করে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এখন শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপ পেয়েছে। একের পর গড়ে উঠছে শিল্প। আসছে বহুমুখী বিনিয়োগ। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। বাড়ছে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণ।
শিল্পায়নের এই প্রসারে পাট, চা ও চামড়াকে পেছনে ফেলে এখন প্রধান রপ্তানি খাত হয়ে উঠেছে তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশেরই জোগান দিচ্ছে পোশাক খাত। এ ছাড়া রপ্তানি ঝুলিতে যোগ হয়েছে ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, রাসায়নিক পণ্য, ইলেকট্রনিক্স, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং ও জাহাজ নির্মাণ, ফার্নিচার, কাগজ ও কাগজপণ্য, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং সামগ্রী, অ্যাগ্রো প্রসেস ফুড, ব্যাগস অ্যান্ড পার্টস, রাবার, খেলনা, আগর, কাঠ, আতর, পাঁপড়সহ ৭২৯টি পণ্য, যা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৯৬টি দেশে।
এ সময়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোগে দেশে শক্তিশালী সেবা খাতেরও প্রসার ঘটেছে। দেশের অর্থনীতিতে এ তালিকায় যোগ হয়েছে ব্যাংক-বিমা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, পরিবহন খাত, উৎপাদন, কৃষি ও বনায়নসহ ২৮টি সেবা খাতের সম্মিলিত কার্যক্রম।
এসবের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যোগ হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প পণ্যের বিপ্লব। সব মিলিয়ে দেশ এখন বহুমুখী পণ্য ও সেবার উৎপাদননির্ভর রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হতে চলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাধীন হওয়ার আগের পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বাস্তবতার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কারণ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত ২০০ বছরের বেশি শাসনামলের ওই সময়ে কৃষি ছাড়া শিল্পের কোনো প্রসার ঘটেনি। এ দেশের কাঁচামাল দিয়ে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হতো যুক্তরাজ্যে। আবার পাকিস্তান আমলে বাঙালি নিয়ন্ত্রণাধীন যে কয়েকটি কারখানা ছিল, তা মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায়। তবে তখনকার সময়ে ব্যাংক-বিমাসহ ছোট-বড় শিল্প-কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজারেরও কম। আর বেসরকারি খাত বলতে যা ছিল, তার ৯৯ ভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্প-কারখানা ও ব্যাংক-বিমার নিয়ন্ত্রণ ছিল ২২ পরিবারের হাতে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই দেশে একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে উঠেছে। প্রায় শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা, কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে পুনর্গঠনে সব ধরনের উদ্যোগই নিয়েছিলেন। যার সূত্র ধরে আজকের এই বাংলাদেশ। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তাও ছিল উল্লেখ করার মতো।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশে একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত সৃষ্টিতে উৎসাহমূলক ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেই এখন দেশে সাড়ে ৩ কোটিরও বেশি লোক ব্যবসায়ী, যারা কৃষি প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে বহুমুখী শিল্প স্থাপন করেছেন, বিভিন্ন সেবা খাত এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর খাতেও বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন। এখন দেশে একের পর এক প্রতিষ্ঠিত করপোরেট শিল্পগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কৃষক থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা তাদের মেধা, মনন, দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত উৎপাদন সচল রাখছেন বলেই দেশ এগিয়ে চলেছে। দেশের কর্মক্ষম পৌনে ৯ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত আছে এই বেসরকারি খাতের সঙ্গে।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে বেসরকারি খাত।
এদিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশে উন্নীত হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণেতারা দাবি করেছেন, এই উদ্যোগ দেশে এফডিআইয়ের দ্রুত বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, জ্ঞান হস্তান্তর ও দক্ষতার উন্নয়ন প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে বড় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে দেশে অতি ক্ষুদ্র, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং বৃহৎসহ প্রায় ৮৮ লাখ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে এসব শিল্পে যে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন হচ্ছে, তা অভ্যন্তরীণ ১৮ কোটি মানুষের চাহিদা মিটিয়েও বিশ্বের ১৯০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এভাবেই কৃষিভিত্তিক এবং আমদানিনির্ভর দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উৎপাদননির্ভর রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের প্রতিবেদনেও সারা দেশে সব মিলিয়ে শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কুটির শিল্প ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান ১০ লাখের বেশি, ছোট শিল্প রয়েছে প্রায় ৯ লাখ। এ ছাড়া মাঝারি শিল্প ৭ হাজার ও বৃহৎ শিল্প ৫ হাজার ২৫০টি।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, গত দুই দশকে শিল্প খাতের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৯ গুণ। ২০০১-০২ সালের বিবিএসের শিল্প উৎপাদন সমীক্ষা অনুযায়ী, সে সময়ে বছরে ৯০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করত শিল্প খাত। আর এখন শিল্প খাত বার্ষিক ৮ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করছে।
শিল্প খাতের বিকাশ সত্ত্বেও সমান্তরালে বেড়েছে কৃষি উৎপাদন। বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ।
তবে কৃষি উৎপাদন বাড়লেও জিডিপি অবদান বিবেচনায় এই সময়ে কমেছে কৃষির প্রাপ্তি। হিসাব অনুযায়ী ৪৫ বছর পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। আবার শিল্প খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে সেবা খাত।
সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ছিল ৫৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আর কৃষি খাতের অবদান কমতে কমতে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাত জোগান দিয়েছে ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।