১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। আর মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন স্টেশন ও সাবস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনটিতে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ হয়েছে ২০০ মেগাওয়াটেরও কম।
বিজয়ের ৫০ বছরে এসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে। কেবল সরকারের নীতি পরিবর্তনের কারণে এই রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইপিপি (বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র) নীতি গ্রহণ করা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আসেন। এ ছাড়া ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ নীতি করে শিল্পে বিদ্যুৎ দেয়া হয়। তখন আইপিপি করার ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যেও দ্বিধা ছিল। সে সময়ের অর্থসচিব আকবর আলী খান আইপিপি করাকে আত্মঘাতী হবে উল্লেখ করে অর্থ দিতে চাননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এসব সমস্যা সমাধান করেন। এরপর ২০০৯ সালে আবার বিদ্যুৎ-সংকটের মধ্যে সরকার দায়িত্ব নিল। তখন থেকে নানারকম নীতির পরিবর্তন করে সরকার বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করে আজকের এ অবস্থায় পৌঁছেছে।’
অন্যদিকে বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০০৯ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করে। ইতোমধ্যে গ্রিডের বিদ্যুৎ ৯৯ ভাগ মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে। আশা করছি, আগামী মার্চের মধ্যে ১০০ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।’
একটা সময় ছিল, যখন সারা দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। জেলার পর জেলা থাকত অন্ধকারে। বিদ্যুতের অভাবে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বিভিন্ন উপকেন্দ্রে হামলা করত। হরতালসহ বড় আন্দোলনও হতো এই বিদ্যুতের দাবিতে।
সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। দেশ এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ। ৯৯ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। মাথাপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষমতা ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে বিদ্যুৎ বিতরণে এখনও কমবেশি সমস্যা রয়েছে। ফলে কোনো কোনো স্থান থেকে এখনও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর আসে।
বিষয়টি স্বীকার করছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নিজেও। তিনি বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছি। এখন আমাদের কোয়ালিটি সরবরাহের দিকে যেতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছি।’
কেবল উৎপাদন ও সরবরাহ লাইনের উন্নতি নয়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর অঙ্গীকার পূরণে প্রতিকূলতা আছে দেশের ভৌগলিক আবস্থানেও। দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বড়বড় নদী। সাগর মোহনায় আছে অসংখ্য দ্বীপ ও জনবসতি। সেসব স্থানে গ্রিডের বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়াও ছিল চ্যালেঞ্জ। শরীয়তপুরের চর আত্রা, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, ভোলার চরকুকরিমুকরি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মতো স্থানগুলোতে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সাবমেরিন কেবল প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে।
দেশে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের পরিকল্পনা সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন দেশে ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধা পাচ্ছে। মুজিববর্ষের মধ্যে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজ চলছে। এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।’
৫০ বছরে বিদ্যুতের পথচলা
একেবারেই সহজ ছিল না ৫০ বছরের এই পথচলা। একাত্তরের মার্চে শুরু হওয়া বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সমগ্র বাংলাদেশ। ওই সময়ে ঠিক কত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল, তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট বিভাগে।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪৭৫ মেগাওয়াট। ১৯৭২ সালে দেশে স্থাপিত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। এই ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যেত না। এই সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এখন উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। যদিও বর্তমানে সংযোগ-চাহিদা আছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ সক্ষমতা দ্বিগুণ।
প্রায় ১২৫ বছর আগে ব্রিটিশ শাসিত পূর্ববঙ্গে গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। তিনি বিলেত থেকে জেনারেটর এনে রাজবাড়ি আলোকিত করেন।
এর পর ১৯০১ সালে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর বাসভবনে একটি জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পর্যায়ক্রমে ঢাকার কয়েকটি অভিজাত ভবনকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়।
সরকারের জ্বালানি বিভাগ জানায়, উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি বিদ্যুৎ হলেও এ খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্বাধীনতার আগে থেকেই বিদ্যুৎ খাত ছিল সরকারনির্ভর। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ছিল অত্যন্ত ঢিমেতালে। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা এ খাতে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এ খাতে কমবেশি বিনিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সময়সাপেক্ষ। ফলে রাতারাতি এ খাতে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি মালিকানার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আইপিপি অর্থাৎ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার নীতিমালা করা হয়। এ সরকারের আমলেই দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগ হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। বেসরকারি খাত থেকেই ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি করা হয়। বিদ্যুৎ খাতে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এরপর ক্রমেই উৎপাদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে বেসকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৮৯; উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। আর সরকারি খাতে কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৪; উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৫৪৪ মেগাওয়াট।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় আরইবি অর্থাৎ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড। উদ্দেশ্য ছিল দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করা। এটি বিদ্যুৎ খাতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ সংস্থার দায়িত্ব ছিল পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা। এই বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে থাকে। কিন্তু উৎপাদন ঘাটতি থাকার কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল খুবই কম। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে পল্লী অঞ্চলে বিতরণ অবকাঠামোও দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন সারাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আছে। পাহাড়ি ও দুর্গম কিছু এলাকা ছাড়া সারাদেশেই পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। বর্তমানে আরইবির গ্রাহকই ৩ কোটি ১১ লাখ। ৮০টি সমিতির মাধ্যমে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
একবিংশ শতকের শুরুতে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের গতি আবারও শ্লথ হয়ে পড়ে। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কারণে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যদিও প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। ঘাটতির কারণে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ২০০৬ সালের মে মাস নাগাদ ১ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে।
এ সময় বিদ্যুতের দাবিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। একই সময় রাজধানীর শনিরআখড়ায় হাজার হাজার এলাকাবাসী বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। বিদ্যুৎ অফিসে হামলা, আগুন, ভাঙচুর ছিল নিয়মিত ঘটনা।
এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরেও এ খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে বার বার পরিবর্তন আসে। কিন্তু এ খাতের চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই সরকার জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার। ২০০৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল যদিও ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট (৬ জানুয়ারি, ২০০৯)। এরপরই বিদ্যুৎ খাতে এক প্রকার বিপ্লব সূচিত হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৩৮ বছরে যা হয়েছে, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি উন্নতি হয়েছে। এই ১২ বছরকে বিদ্যুৎ খাতের সোনালি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।
২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। বর্তমানে ১৪৪টি। ১২ বছরে বেড়েছে ১১৭টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট। বেড়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার; বর্তমানে ১২ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। বেড়েছে ৪ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। গ্রিড উপকেন্দ্র ছিল ১৫ হাজার ৮৭০টি। বর্তমানে ৪৯ হাজার ৩৮৪টি। বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫১৪টি। বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ৬ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। বেড়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বর্তমানে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। বেড়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ। সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কমেছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও এ অবধি সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। ব্যাখ্যা হলো, বিদ্যুৎ এমনই একটা পণ্য, এটা মজুদ করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ততটুকুই বিতরণ হয়ে যায়। সারা দেশে বর্তমানে যে সংযোগ আছে, (আবাসিক, বাণিজ্য, শিল্প মিলিয়ে) সেখানে সংযোগ চাহিদা ওই ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ কাঠামো সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ কোনো একদিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমানে এর দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও তা পূরণ করা কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।
বিশ্লেষকরা জানান, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদন-ক্ষমতা সবসময় কিছুটা উদ্বৃত্ত রাখা হয়। কারণ, যেকোনো সময় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হয়ে পড়তে পারে।
মাস্টারপ্ল্যান ২০৪১
বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ নীতি অনুসরণ করা হয়। কারণ বিশ্ববাজারে বিভিন্ন রকম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করে। আমাদের দেশে এক সময় অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। এখন গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পারমাণবিক শক্তি, ডিজেল, পানি, সৌরশক্তি, বায়ু ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কথা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এ জন্য সোলার বা সৌর, বায়ু, পানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান ভিশন-২০৩০ এ বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ মুখ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৫০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা মেটাতে হবে, যার ২৫ শতাংশ হবে কয়লা, ২০ শতাংশ হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাকি ৫ শতাংশ হাইড্রো ও নবায়নযোগ্য শক্তি।
তবে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকার মাস্টারপ্ল্যানে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। এ ক্ষেত্রে কয়লাভিত্তিক ১০টি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করে নবায়নযোগ্য ও গ্রিন এনার্জির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের নতুন মাস্টারপ্ল্যানকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত টার্গেট ধরা হয়েছে।
২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ৫২ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ২৭ শতাংশ, ডিজেল ৬ শতাংশ, কয়লা ৮ শতাংশ, জল ১ দশমিক ১ শতাংশ, গ্রিড সোলার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ আমদানি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ভিশন ২০৩০-এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ ও এসডিজির দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার মাস্টারপ্ল্যানে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জ্বালানি উন্নয়নে শীর্ষ ১০ এ বাংলাদেশ
ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিলের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এনার্জি ট্রিলেমা ইনডেক্স-২০২০-এর তথ্য বলছে, জ্বালানি খাতের দ্রুত উন্নয়ন করছে এমন শীর্ষ দশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জ্বালানি নিরাপত্তায় বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৯। একই মানদণ্ডে পরিবেশগত টেকসই বিষয়ে বাংলাদেশের স্কোর ৫৬ এবং জ্বালানি সরবরাহ ও প্রাপ্যতায় ৫০ দশমিক ৪। সদস্যভুক্ত ৮৪টি দেশসহ মোট ১৩৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই র্যাংকিং প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিল।
সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি খাতের উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের জিডিপিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
জ্বালানি সরবরাহ বিবেচনায় গত পাঁচ বছরে মানসম্মত জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে বাংলাদেশে। এ সময়ে জ্বালানির প্রাপ্যতা বেড়েছে ৬ শতাংশ, সরবরাহ সক্ষমতা বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ৯ শতাংশ।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।