প্লাস্টিকের ওপর কয়েক টুকরা ছেঁড়া কাপড় বিছিয়ে স্টেশনের শীতল মেঝেতে শুয়ে ঘুমের অপেক্ষায় বৃদ্ধা সাবিনা ইয়াসমিন। শীতের হাত থেকে বাঁচতে গায়ে জড়িয়েছেন ছেঁড়া গামছা।
শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে দিনের পর দিন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এভাবে অনেক শীত পার করেছেন তিনি। দুজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে দুটি কম্বল পেলেও এখন একটিও নেই তার কাছে। তাই হালকা বা ভারী শীতেও পাতলা আর ছেঁড়া গামছাই এখন তার রক্ষাকবচ।
বুধবার রাত ১টার দিকে (১৬ ডিসেম্বর) ঠাকুরগাঁও রোড রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা যায় এ চিত্র।
ফুল দিয়ে মহান বিজয়কে বরণ করতে যেখানে সারা দেশ ব্যস্ত, সেখানে ছিন্নমূল মানুষেরা কষ্ট আর দুশ্চিন্তায় রাত পেরোনর অপেক্ষায়।
তাই চোখেমুখে শঙ্কা আর এক সাগর আক্ষেপ নিয়ে সাবিনা ইয়াসমিনকে বলতে শোনা যায়, ‘স্বামী মারা গেছে, এক ছেলে ও তিন মেয়ে মারা গেছে। ঘর নাই বহুকাল ধরে। শ্বাসকষ্ট রোগ নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকি। ‘যখন শরীরে দম ছিল তখন বাসাবাড়িতে কাজ করে পেট চালাইছি। এখন হাত পেতে যা পাই তা দিয়ে দিন যায় একবেলা খেয়ে! চিকিৎসা করা তো দূরের কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এভাবেই একদিন মরে যাব। কবর পাব কি না তাও জানি না। সরকারের এ একখান কম্বল নিয়ে কী হবে বাপু? যদি একটা ঘর দিত তাহলে অন্তত মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হতো।’
রেলস্টেশনেই কথা হয় আরেক ছিন্নমূল মানুষ আব্দুল গনি মিয়ার সঙ্গে। হাজারো হতাশার মধ্যেও আশার আলো খুঁজছেন তিনি। তাই একগাল হাসি দিয়ে বলেন, ‘আজকের দিনে বাংলাদেশ বিজয়ের মুখ দেখে। চারদিকে উৎসব চলছে। উঁচু দালান সাজিছে লাল, নীল বাতিতে। হামরা ভালো আছি বাবা।
‘সে সময় তো পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে এমনি করে খোলা আকাশতও থাকা যাছিল না। এলা তো তাও অভয়ে ঘুমাবা পারিছি। না হয় লাগিল অনেক ঠাণ্ডা। না হয় খাইতি পানু না তিন বেলা।’
শুধু সাবিনা বা শুধু গনি মিয়া নন, এমন অনেক মানুষের কাছে বিজয়ের আনন্দ এখনও ম্লান। শঙ্কার তরী বেয়ে পার করা নিরানন্দের জীবন তাদের।
সমাজের এ শ্রেণির মানুষ নিয়েও ভাবতে হবে বিশেষভাবে। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহাবুব আলম রুবেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি চলছে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বীর শহীদদের প্রতি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনার পর দেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়েছে।
‘কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে প্রকৃত ইতিহাস, যে অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করল তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটি ভাবতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সমাজে ধনী ও গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। যার বাস্তব চিত্র এ প্ল্যাটফর্ম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এক চোখে আনন্দ রেখে অন্য চোখে এ ছিন্নমূল মানুষের দিকেও তাকাতে হবে। আনন্দ-উল্লাস তাদের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই দেশ এগিয়ে যাক। বিজয়ের অঙ্গীকার হোক সমাজ পরিবর্তনের।’
এর আগে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জেলায় দিন দিন শীত বাড়তে শুরু করেছে। শীতকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ছিন্নমূল, গরিব, অসহায় শীতার্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে কিছু বিতরণও করেছি।
‘এ ছাড়া আমরা আট লাখ টাকা পেয়েছি। এগুলো দিয়ে তাদের সহযোগিতা করা হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সংগঠনও তাদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে।’