দেশে পঞ্চম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আগামী ৫ জানুয়ারি ভোট হবে যশোর সদর উপজেলার ১৫টি ইউপিতে। এরই মধ্যে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
তবে চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বিপাকে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। জেলা সদরের সব ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে দলটির। কোনো কোনো ইউপিতে দলে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন।
এ ছাড়া দলীয়ভাবে এবার ইউপি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও দলটির একাধিক নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে তারা ভোটে সুবিধা পাবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এমন পরিস্থিতিতে সদরের ১৫টি ইউপিতে নৌকার প্রার্থীদের নিজ দলেরই ৩৯ বিদ্রোহী প্রার্থীর মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে ১১ ইউনিয়নে মাঠে নেমেছেন বিএনপির ১৪ জন প্রার্থী।
জেলার হৈবতপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে আবু সিদ্দিককে। তবে এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবু বক্কার গাজী, দলের কর্মী হরেণ কুমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট নেতা আহম্মদ আলী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোমিনুর রহমান। ভোটে জিততে অন্য প্রার্থীর পাশাপাশি দলের এসব নেতাদের সঙ্গেও লড়তে হবে আবু সিদ্দিককে।
এ ছাড়া এ ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলনের সোহরাব হোসেন, জাকের পার্টির আবুল হোসেন এবং বিএনপির রবিউল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
লেবুতলা ইউপিতে নৌকা পেয়েছেন আলীমুজ্জামান মিলন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই শহিদুল ইসলাম।
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের সাখাওয়াত হোসেন ও জাকের পার্টির পলাশ পারভেজের সঙ্গেও লড়তে হবে তাকে।
ইছালীতে আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন ফেরদৌসী ইয়াসমিন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন, আওয়ামী লীগ কর্মী শাহানারা খাতুন ও আজিজুর রহমান।
এ ছাড়া বিএনপি নেতা জাহিদুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান, জাকের পার্টির সিরাজুল ইসলাম ও সাইফুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আব্দুল কাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নওয়াপাড়ায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রাজিয়া সুলতানা। এই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর তুহিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য কাজী আলমগীর হোসেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক মোশাররফ হোসেন, জেলা যুবলীগ সদস্য কেরামত আলী মোল্লা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান। সেই হিসাবে নৌকার প্রার্থীকে লড়তে হবে দলেরই পাঁচ প্রার্থীর সঙ্গে।
একই ইউপিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতা আলতাফ হোসেন ও যুবদল নেতা আসাদুল আলম ঝন্টু।
উপশহরে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন এহসানুর রহমান লিটু। এই ইউনিয়নে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন রত্ন।
কাশিমপুরে আওয়ামী লীগের নৌকা পেয়েছেন শরিফুল ইসলাম। এই ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মেহেদী খালিদ হোসাইন ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএম সাইফুল দলের বিদ্রোহী হয়েছেন।
একই ইউনিয়নে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন ও হাতপাখার মোস্তফা এনামুল বারি।
চুড়ামনকাটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দাউদ হোসেন। তার বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান মুন্না, প্রজন্ম লীগ নেতা আলমগীর কবির, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ও শ্রমিক লীগ নেতা মোহাম্মদ বাদশা।
আরও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির সাইফুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আব্বাস উদ্দিন বিশ্বাস ও জাকের পার্টির মতিয়ার রহমান।
দেয়াড়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী লিয়াকত আলীকে অন্য প্রার্থীর পাশাপাশি লড়তে হবে ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমানের সঙ্গেও। এখানে আরও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির জিয়াউর হক ও ইসলামী আন্দোলনের আব্দুল্লাহ।
আরবপুরে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মীর আরশাদ আলী রহমান। এ ইউপিতে দলের বিদ্রোহী রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন নুরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান ও খন্দকার ফারুক আহমেদ।
এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান ও জাকের পার্টির গাজী রফিকুল ইসলাম মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
চাঁচড়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিম রেজা পান্নু। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আব্দুল আজিজের ছেলে শামীম রেজা ও তাঁতি লীগের সাবেক নেতা ফারুখ হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
এ ছাড়া মাদ্রাসার সুপার ফারুক হোসেন, বিএনপির গোলাম মোস্তফা ও ইসলামী আন্দোলনের সামছুর রহমান মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
রামনগরে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী নাজনীন নাহার। এখানে আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল হোসেন, জেলা তরুণ লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান লাইফ, আওয়ামী লীগ কর্মী জুলেখা বেগম ও শেখ জামাল উদ্দিন টুটুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
ফতেপুরে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন শেখ সোহরাব হোসেন। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ কর্মী ফাতেমা আনোয়ার, আবু তাহের সনু, আলমগীর হোসেন ও শিল্পী খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
এ ছাড়া আছেন বিএনপির আফজাল হোসেন, ইসলামী আন্দোলনের আব্দুস সাত্তার তরফদারসহ আরও কয়েকজন।
কচুয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন লুৎফর রহমান ধাবক। এখানে আওয়ামী লীগ কর্মী শেখ মাহমুদ হোসেন ও আব্দুর রশীদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির মশিয়ার রহমান খান ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বাবুল হুসাইন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নরেন্দ্রপুরে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোদাচ্ছের আলী। এই ইউনিয়নে যুবলীগ নেতা রাজু আহমেদ, সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হোসেন ফেরদৌস আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
বসুন্দিয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রিয়াজুল ইসলাম খান রাসেল। এই ইউনিয়নে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আজিজুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির তুহিন খান ও শেখ সাহাবুদ্দিন এবং বিএনপির নুরুজ্জামান খান ও এসকে মুমিনুল ইসলাম আমিনুল প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
জেলা বিএনপি নেতারা যা ভাবছেন
স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করা বিএনপির দুই নেতা জানিয়েছেন, অনেক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় মানুষকে মনোনয়ন দিয়েছে। এ কারণে ভোটাররা তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
একই কারণে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত অনেক নেতা-কর্মী তাদের ভোট দেবেন বলেও দাবি তাদের। এ জন্য তারা যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে যশোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশনের আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আশা করি না। বিএনপি দলীয়ভাবে ভোটে যাচ্ছে না। যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তারপরও নির্বাচন করতে নিরুৎসাহী করা হচ্ছে।’
জেলা আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে যা ভাবছেন নেতারা
যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহিত কুমার নাথ জানান, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করা হবে। তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহারে আলোচনা চলছে।
বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে বিএনপি নেতারা সুবিধা পাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, মাঠে বিদ্রোহী থাকলে তো বিএনপি সুবিধা পাবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যেন বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকে।’
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘যারা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজীবন বহিষ্কার করা হবে।’
তবে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে বিএনপি নেতারা ভোটে বিশেষ সুবিধা পাবে বলে মনে করেন না এ নেতা।
নৌকা প্রতীকে প্রথমবার মনোনয়ন পাওয়া নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে নির্বাচনে জেতা কষ্টসাধ্য। যেন কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকে দলীয় নেতৃত্ব এমন পদক্ষেপ নিলে সংকট থেকে উদ্ধার হওয়া যাবে।’
কাশিমপুর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি প্রার্থী আয়ুব হোসেনকে জেতাতে কাজ করছেন গোপনে। তবুও জনগণ সঙ্গে আছে, তাদের সমর্থনে নির্বাচনে জিততে পারব।’