পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বদলে গেছে। স্বাধীনতার পরের প্রায় দুই দশক দেশের অর্থনীতি বিদেশি সাহায্যনির্ভর ছিল। বিদেশি সহায়তা ছাড়া উন্নয়ন বাজেট করা যেত না। ঋণ পাওয়া যেত না প্রকল্পের জন্য।
সেই চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়েছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ জোগানের ক্ষমতা বেড়েছে বহু গুণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা। এডিপিতে বরাদ্দের ৮০ শতাংশ অর্থ দিয়েছিল উন্নয়ন সহযোগীরা।
পাঁচ দশক পরে এডিপিতে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ। অবশিষ্ট বেশির ভাগ অর্থ আসছে দেশি উৎস থেকে। এর অর্থ হলো বিদেশি ঋণ নির্ভরশীলতার পরিবর্তে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিদেশি ঋণ নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমছে। এটি দেশের জন্য সুখবর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে। রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। ফলে বিদেশি ঋণ নির্ভরশীলতা কমছে। উন্নয়ন সহয়োগীরা সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ঠিকমতো ছাড় হয় না। ফলে পাইপলাইনে বিশাল অঙ্কের টাকা আটকে আছে। তার পরও আমি মনে করি, বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। এটা দেশের জন্য সুখকর।’
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি অর্থায়ন বাড়লেও বদলে গেছে সাহায্যের ধরন।
১৯৭২-৭৩ সালে উন্নয়ন সহযোগীরা সাহায্য দিয়েছিল ঋণ এবং অনুদান মিলিয়ে ৫৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে অনুদান ৪৮ কোটি ডলার। বাকিটা ঋণ। অর্থাৎ সাহায্যের ৮৯ শতাংশ ছিল অনুদান। বাকি ১১ শতাংশ ঋণ। বর্তমানে ৯৮ শতাংশই আসে ঋণ হিসেবে। অবশিষ্ট দুই শতাংশ অনুদান।
গত অর্থবছরে ঋণ-অনুদান মিলে মোট সহায়তা পাওয়া গেছে ৭১১ কোটি ডলার।
ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পুঞ্জিভুত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৪০২ কোটি ডলার। আর মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৬ দশমিক ৮ ডলার, স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২৩ হাজার টাকা।
অবশ্য, ঋণের আকার বাড়লেও মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় সেটি কমই আছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বিদেশি ঋণ ছিল জিডিপির ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
দুই দশকে আগে যে পরিমাণ ঋণ পাওয়া গেছে, তা ছিল জিডিপির ৩০ শতাংশ। তার মানে ঋণের পরিমাণ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে কমেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ বাড়লেও তাতে কোনো ঝুঁকি নেই। বিদেশি ঋণ গ্রহণে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ সহনীয় অবস্থায় রয়েছে। তার কারণ, বাংলাদেশে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়ছে। এ জন্য বিদেশি ঋণ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
গবেষণা সংস্থা পিআরই-এর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনুসর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাথাপিছু জাতীয় আয়ও বাড়ছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ বাড়লে অসুবিধার কিছু নেই। তবে এখন যেহেতু সরকারের রাজস্ব আয় তুলনামূলক কম, সেহেতু ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারকে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হতে পারে।’
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, পুরো সত্তরের দশক জুড়েই উন্নয়ন বাজেটের ৮০ শতাংশ খরচ মেটানো হতো বিদেশি সহায়তা দিয়ে।
নব্বই দশকে উদারনীতি গ্রহণের ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে, যার ইতিবাচক প্রভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়তে থাকে।
নব্বইয়ের দশক থেকেই ধীরে ধীরে বিদেশি সহায়তানির্ভর এডিপি বানানোর প্রবণতা কমে যায়। ১০ বছর ধরে প্রতি বছর এডিপির এক-তৃতীয়াংশ খরচ মেটানো হয় বিদেশি সহায়তায়।
বিদেশি ঋণ তুলনামূলক সস্তা, যে কারণে সরকার বেশি বিদেশি ঋণ নিতে আগ্রহী। আগে খাদ্য সহায়তার নামে কিছু অর্থ আসত। এখন প্রায় পুরো টাকা প্রকল্প সাহায্যের নামে আসে।
ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ যে ঋণ নেয়, তার বেশির ভাগই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে। এসব ঋণ নমনীয়। এ কারণে সুদ পরিশোধে চাপ কম থাকে।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা বিশ্বমানের বলেও জানান তিনি।
পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেট অর্থায়নে বিদেশি ঋণ নির্ভরশীলতা কমলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার দরকার আছে। বিদেশি ঋণের অংশ কমিয়ে আনতে হলে আমাদের রাজস্ব আদায়ে আরও বেশি নজর দিতে হবে।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অর্থায়নে বিদেশি সাহায্য ক্রমশ হ্রাস পেলেও এখনও উল্লেখযোগ্য অংশ বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এডিপিতে অর্থ বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ বিদেশি সহায়তার মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এক দশক আগে এর অংশ ছিল ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৫৩৮টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি মুদ্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিদেশি সহায়তা পায়। বহুপক্ষীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। আর দ্বিপক্ষীয়র মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ দেয় জাপান। বর্তমানে চীন এবং ভারতও বাংলাদেশকে মোটা অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে। তবে এই দুটি দেশের ঋণের সুদ হার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তুলনায় বেশি এবং শর্তও থাকে জটিল।