একাত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশের যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন দেশে আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি স্নাতকোত্তর মেডিকেল ইনস্টিটিউট, ৩৭টি যক্ষ্মা ক্লিনিক, ১৫১টি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৯১টি মাতৃ ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র ছিল।
৫০ বছর পর এখন দেশের প্রতিটি উপজেলায় আছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এগুলো ৩১ থেকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ আছে। এ ছাড়া আছে পৃথক মা ও নবজাতক বিভাগ। বিশেষায়িত রোগ ছাড়া এইসব হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
এসব হাসপাতালে টিকা দেওয়া হয়, শ্বাসতন্ত্রের তীব্র প্রদাহের চিকিৎসা দেয়া হয়, পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া হয়। পুষ্টিসেবার জন্য আছে বিশেষ কর্নার। আছে এক্স-রে সুবিধাসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ।
দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র আছে। সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১০০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক সরকার গড়ে তুলেছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বেশ কিছু মাইলফলক ছুঁয়েছে দেশ। নবজাতক ও প্রসূতিদের মৃত্যু কমিয়ে আনা, পোলিও নির্মূল, কলেরা, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে খাবার স্যালাইনের ব্যবহার, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, টাইফয়েড রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও জনগণের সম্মিলিত অর্জনের মাধ্যমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামীতে সবার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে অন্যান্য মাইলফলকও ছুঁতে পারবে দেশ। তবে প্রয়োজন নীতিমালা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রায় সব সূচকে তলানিতে ছিল বাংলাদেশ। ৫০ বছরে সেই দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় টপকে গেছে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরও বহু দেশকে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সারা দেশে ১৫ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ও স্যাটেলাইট ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যামে গ্রামের মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে।’
এই বিশেষজ্ঞ জানান, পাঁচ দশকের ব্যবধানে দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকেরা দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের চাহিদা মিটিয়ে ওষুধ রপ্তানি করছে। তবে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ এখনও ব্যক্তির পটেক থেকে যায়। করোনার মধ্যে এই ব্যয় আরও বাড়ছে।
ডব্লিউএইচও ও বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে গত বছর বিশ্বের ৫০ কোটির বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যের দিকে চলে গেছে। এর বাইরে নয় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দেশের বড় একটি শ্রেণি চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখি হচ্ছে। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে এগুলো বড় বাধা।
স্বাস্থ্যসেবার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক
স্বাধীনতার পরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায় থাকলেও দীর্ঘ ৫০ বছরে গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমন্বয়ে সারা দেশে প্রাথমিক চিকিৎসার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোও তৈরি হয়েছে। গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় সেবা নিয়ে গেছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এ ছাড়া জেলা ও সদর হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তো রয়েছেই।
এসবের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা, টিকা, যক্ষ্মার চিকিৎসা, পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রায় ২৭ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে দেয়া সেবার মধ্যে আছে: মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা, প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান, পুষ্টিশিক্ষা ও অনুপুষ্টি কণা সরবরাহ, স্বাস্থ্যশিক্ষা, বয়স্ক ও কিশোর-কিশোরীদের লক্ষণভিত্তিক শিক্ষা, অসংক্রামক রোগ শনাক্তকরণ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার কারণে স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে। মহামারি মধ্যে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। অন্যান্য দেশ যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে, আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। এর জন্য একটি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অটোমেশন, রোবোটিক সার্জারিসহ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশেই আছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ চিকিৎসা সেবায় আরও এগিয়ে যাবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সময় দেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামো ছিল না বললেই চলে। তবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোকে সেবা দেয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ অর্গানোগ্রাম ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা দূর করতে হবে।’