১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের সর্বাধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। মুক্তিযুদ্ধের ইস্টার্ন থিয়েটারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৯৪ হাজার সেনাসদস্যসহ আত্মসমর্পণ করেন তিনি।ভারতীয় বাহিনীর কাছে আড়াই বছর যুদ্ধবন্দি থাকার পর দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হন নিয়াজী।১৯৭৪ সালের এপ্রিলে জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর যোগ দেন রাজনীতিতে। বরাবর জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরোধিতা করেন তিনি। কারণ তার বিবেচনায় পাকিস্তান বিভক্তির জন্য দায়ী ভুট্টোই।জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত ইতিহাস নিবন্ধিত থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে কী হয়েছিল, সে আখ্যান খুব একটা প্রচলিত নয়। বিশেষ করে তার ভারতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে অবস্থান ও পাকিস্তানে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর রাজনৈতিক জীবন তার সামরিক জীবনের মতো এতটা ঘটনাবহুল নয়।আত্মসমর্পণের পর নিয়াজীসহ সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের ২০ ডিসেম্বর কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। জায়গা হয় ভারতের মধ্যপ্রদেশের জবলপুর সেনানিবাসের বিশেষায়িত ক্যাম্পে। সেখানে তাদের রাখা হয় দুই বছর।ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়াজীসহ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের জবলপুরে ক্যাম্পে রাখার বিষয়টির গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। সাধারণ জনগণ তো নয়ই, সামরিক বাহিনীর সব সদস্যের কাছেও নিয়াজী ও তার সিনিয়র অফিসাররা কোথায় আছেন সেটা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না।১৯১৫ সালে পাঞ্জাবে জন্ম নেয়া নিয়াজী ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ওয়াই ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর ব্রিটিশ আর্মির কমিশনড অফিসার হিসেবে আসাম ও মনিপুর ফ্রন্টে বার্মা যুদ্ধে যোগ দেন। ঘটনাচক্রে এর তিন দশক পর সেই ভারতেই তাকে যুদ্ধবন্দি জীবন কাটাতে হয়।নিয়াজী ও তার অফিসারদের যুদ্ধবন্দি সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত একটি প্রশাসনিক চিঠি জবলপুরের সেনা জাদুঘরে এখনও দর্শনার্থীদের জন্য রেখে দেয়া আছে।পিওডাব্লিউ ক্যাম্প হান্ড্রেড নামে পরিচিত এলাকাটি এখন অনেকটাই বদলে গেছে ও নাম পাল্টে রাখা হয়েছে ভিজায়ান্তা ব্লক।
নিয়াজী তার আত্মজীবনীতে বন্দিজীবনে পাওয়া সুযোগ-সুবিধাগুলোর একটা বর্ণনা দিয়েছেন।তার ‘বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে নিজের বন্দিজীবন নিয়ে নিয়াজী লিখেছেন, ‘কোনো একটা ইউনিটের ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমরা প্রত্যেক অফিসার একটি করে কোয়ার্টার পাই। এক বেডরুম, সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম ও বারন্দাসহ একটা বসার জায়গা ছিল প্রতিটি কোয়ার্টারে। মোটামুটি সুসজ্জিত ছিল রুমগুলো। বসবাসের জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল। যে কারণে আমরা একটিকে মসজিদ ও আরেকটিকে মেস বানিয়ে নিয়েছিলাম।’দৈনিক ভাতা হিসেবে তাদের ১৪০ রুপি করে দেয়া হতো। বই পড়ার সুযোগও তার ছিল।ওই সময়ে সেনানিবাসে চাকরিরত বেসামরিক কর্মকর্তা সুজয় ব্যানার্জি টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে জানান, নিয়াজী ও তার অফিসাররা যে জবলপুরে আছেন সেটা তিনি লোকমুখে শুনেছেন, তবে কখনও দেখেননি। পত্রপত্রিকায় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে লেখালেখি হলেও কে কোথায় আছে, সেটা প্রকাশ পেত না।তিনি বলেন, ‘নিয়াজী যে ওখানে আছেন, সেটা জানতেন হাতে গোনা কয়েকজন। অনেকে ক্যাম্পের বাইরের টিলাগুলোয় উঠে দেখার চেষ্টা করত আসলেই উনি ভেতরে আছেন কি না।’নিয়াজী লিখেছেন, পাকিস্তান সরকার তাকে হত্যা করার জন্য দুইজন আততায়ী পাঠিয়েছিল ভারতে। ওই দুই আততায়ীর হাত থেকে নিয়াজীকে রক্ষা করতে বন্দিশিবিরের চতুর্দিকের দেয়াল উঁচু করে দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।বইয়ে তিনি লেখেন, ‘একপর্যায়ে আমি দেখলাম ক্যাম্পের চারদিকে ভারতীয়রা দেয়াল নির্মাণ শুরু করেছে। আমি প্রতিবাদ করলে স্টেশন কমান্ডার মেজর জেনারেল পাড্ডা আমাকে জানান তাকে দিল্লির হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কলকাতা থেকে জামশেদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। জামশেদ স্বীকার করেছে যে তাকে ও তার এক সঙ্গীকে পাকিস্তান সরকার পাঠিয়েছে নিয়াজীকে হত্যার জন্য। যে কারণে জেনারেল পাড্ডাকে হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হয়েছে আমার সুরক্ষা ও জীবন রক্ষার ব্যবস্থা নিতে।’১৯৭২ সালের ২ জুলাই স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি অনুসারে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান ফিরে আসেন নিয়াজী।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় এবং ভারতের কাছে ৯৪ হাজার সেনার বন্দি হওয়া ও নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে পাকিস্তানের জনগণের মনে জন্ম নেয় অসংখ্য প্রশ্নের, যা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ক্ষোভে।বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের পর ক্ষমতা ছেড়ে দেন পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। দায়িত্ব পান জুলফিকার আলী ভুট্টো।দেশের জনগণের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতা ও ভয়াবহতা একরকম আড়াল করে রেখেছিল ইয়াহিয়া সরকার। তবে দাবির মুখে ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান অধীনে কাজ করা শুরু করে তদন্ত কমিশন।
আত্মসমর্পণের পর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন জেনারেল নিয়াজী। ছবি: সংগৃহীত
গোপনভাবে ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন কাজ শুরু করে। ২১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। ১২ জুলাই প্রেসিডেন্টের কাছে টেনটেটিভ বা সাময়িক প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় প্রেসিডেন্টের কাছে।১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ভারত থেকে যুদ্ধবন্দিরা ফিরে এলে নিয়াজীসহ মোট ৭২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে কমিশন। এরপর আরেকটি সম্পূরক রিপোর্ট জমা দেয়া হয়।কমিশনের রিপোর্টে নিয়াজী সম্বন্ধে বলা হয়, ‘শিয়ালকোট ও লাহোরের জিওসি এবং সামরিক প্রশাসক থাকার সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল কোর্ট মার্শাল বা সামরিক আইনের মামলাগুলোয় তিনি অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন। লাহোরের গুলবার্গে সায়িদা বুখারির সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সায়িদা সিনোরিতা হোম নামে একটি যৌনপল্লি চালাতেন। একই সঙ্গে সায়িদা ঘুষ নিয়ে নিয়াজীর কাছ থেকে কাজ উদ্ধার করতেন। নিয়াজীর বিরুদ্ধে নৈতিকতাবিরোধী কাজ ও চোরাচালানের যে অভিযোগ রয়েছে, তা আপাতদৃষ্টিতে সত্য।’নিয়াজীর বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে এই অভিযোগও ছিল যে সামরিক ক্ষমতাবলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পান চোরাচালান করতেন।কমিশনের করা সুপারিশের মধ্যে ছিল ‘অফিসারদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অপরাধমূলক অবহেলার অভিযোগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ, মেজর জেনারেল রহিম খান, ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার হায়াত ও ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজীর কোর্ট মার্শাল করা যায়।’তবে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়াজী নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সামরিক আদালতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তাব দেন। নিয়াজীর বক্তব্য ছিল, হামুদুর রহমান কমিশনের সামরিক বিষয় নিয়ে কোনো ধারণা নেই।এর পরই তাকে সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদে অবনমিত করা হয়। বন্ধ করা হয় তার অবসরকালীন ভাতা। বাতিল করা হয় সেনাবাহিনী থেকে তার নামে বরাদ্দকৃত জমি। ১৯৭৫ সালে তিনি চাকরিচ্যুত হন।তার আত্মজীবনীতে নিয়াজী লেখেন- তাকে ভুট্টো সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খান আব্দুল কাইয়ুম খান রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। নিয়াজী লিখেছেন, “তিনি আমাকে তার কাইয়ুম লিগে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ দেন। আমি তাকে জানাই যে এটা অত্যন্ত সম্মানের বিষয়, কিন্তু আমি এটা গ্রহণ করতে পারব না। তিনি কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি বলেছিলাম, ‘খান লালা আপনি ভুট্টোর সরকারের একজন মন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি আপনার সহানুভূতি থাকবে। আর আমি তার ঘোর বিরোধী।’তিনি বলেন, ‘আসলে ভুট্টো আমাকে পাঠিয়েছেন কমান্ডার অফ সিভিল আর্মড ফোর্সেস পদের জন্য। রাজনীতিতে আমন্ত্রণ জানানোটা আসলে একটা বাহানা।’আমি আবারও তাকে বলি, ‘খান লালা খুবই লোভনীয় একটা প্রস্তাব। কিন্তু ভুট্টো আমাকে মন থেকে ঘৃণা করে। আমি একটা কোর্ট মার্শাল চেয়েছিলাম কিন্তু ভুট্টো পর্যাপ্ত অভিযোগ খুঁজে পায়নি।আমি যদি আবার সামরিক ইউনিফর্ম গায়ে চাপাই, তাহলে সে আবার একগাদা অভিযোগ দাঁড় করাবে ও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। এমনকি আমাকে ফাঁসিও দিতে পারে’।’’নিয়াজীর দাবি, ভুট্টো স্বয়ং তাকে একটি কূটনীতিবিদের পদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটিও প্রত্যাখ্যান করেন।তিনি লিখেছেন, ‘ভুট্টো আমাকে কূটনৈতিক একটি চাকরির প্রস্তাব দেন। তবে তার শর্ত ছিল যে আমাকে জনসমক্ষে স্বীকার করে নিতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের পরাজয় ছিল একটি সামরিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক নয়।‘আমি ভুট্টোকে মুখের ওপর না করি। তাকে বলি যে এটা একটা রাজনৈতিক পরাজয় ছিল। আর যে সামরিক পরাজয় ঘটেছে, সেটা তার কারণে হয়েছে। তিনি সামরিক বাহিনীকে খাটো করতে চান। তিনি আমাকে বিষয়টি ভেবে দেখতে বলেন; না হলে আমাকে দেখে নেবেন বলে হুমকিও দেন।’আজীবন নিয়াজী ভুট্টোর বিরোধিতা করে গেছেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি জামিয়াত উলেমা-ই-পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে যোগ দেন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সে (পিএনএ)।ভুট্টো সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তার কারাবাসের সময়ই জেনারেল জিয়াউল হক মার্শাল ল জারি করে ভুট্টোকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। নিয়াজী যে কারাগারে ছিলেন, সে সুক্কুর জেলেই জায়গা হয় ভুট্টোর।কারাগারে ভুট্টো তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন বলে দাবি নিয়াজীর। তিনি লিখেছেন, “ভুট্টো দেখা হওয়ার পর তাকে বলেন, ‘নিয়াজী আমি অত্যন্ত দুঃখিত তোমার সঙ্গে কঠোর হওয়ার জন্য। আমাকে ভুল পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।’‘আমি তাকে আমার রুমে নিয়ে যাই ও তাকে এক কাপ কফি খাওয়াই। তিনি আমাকে বলেন, ‘আমরা ফিরে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করব।’ জবাবে আমি তাকে বলি, ‘ভুট্টো আমরা কীভাবে একসঙ্গে কাজ করব। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। আমরা একে অপরের শত্রু’।”১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় নিয়াজীর আত্মজীবনী। বইটির প্রায় পুরো অংশই ছিল কীভাবে রাজনৈতিক মতবিভেদের কারণে পাকিস্তান আর্মির মতো শক্তিশালী বাহিনীকে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।বইয়ের শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য না করা হতো, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা আরও দীর্ঘদিন দখলে রাখত পারতাম। ওই সময় ভারতীয়রা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল আর আমাদের দখলে ছিল বড় শহর, বিমান ও নৌবন্দরগুলো।’নিয়াজী লাহোরে মারা যান ২০০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। শেষ দিন পর্যন্ত তার বিশ্বাস একই ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও পাকিস্তানের বিভাজন ও পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি।