স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা মানুষের মন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি মুক্তি পায় রোমান্টিক ড্রামা ঘরানার সিনেমাটি। মুস্তাফা মেহমুদ পরিচালিত এ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, ববিতা, আনোয়ার হোসেন, রোজী আফসারী, আনোয়ারাসহ অনেকে।
স্বাধীন দেশে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে। একের পর এক নতুন সিনেমা হল তৈরি হতে থাকে। চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে প্রধান বিনোদন মাধ্যম।
স্বাধীনতার পরের বছরই প্রায় ৩০টির মতো সিনেমা মুক্তি পায়, যার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধত্তিক সিনেমা ওরা ১১ জন। সে বছর মুক্তি পায় মন্টু পরদেশী এবং রূপকার নামের দুটি উর্দু ভাষার সিনেমাও।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালেও মুক্তি পায় প্রায় ৩০টির মতো সিনেমা। এর মধ্যে তিনটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা, একটি ছিল উর্দু। ওই বছরই মুক্তি পায় ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম।
এটির প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর সিনেমা ব্যবসা ভালো ছিল। সেটা বোঝা যায় সিনেমা নির্মাণের পরিমাণ এবং প্রেক্ষাগৃহের বৃদ্ধি দেখে। ব্যবসা ভালো ছিল বলেই তা হয়েছে।’
১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৭ সালে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩১, ৩৪, ৪৬, ৩০টি করে। ’৭৮ থেকে ’৮৫ পর্যন্ত সিনেমা মুক্তির সংখ্য কমে যায়। ১৯৮৬ সালে সিনেমা মুক্তির সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৫০-এ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩১৩টি। এর মধ্যে ঢাকায় ১৩টি আর সারা দেশ মিলিয়ে বাকি ৩০০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল বলে জানান চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিঞা আলাউদ্দিন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারণ তখন সিনেমার ভালো ব্যবসা ছিল। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সিনেমা হল বেড়েছে। তখন সিনেমা হলের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ১৪শর ওপর।’
প্রেক্ষাগৃহ বৃদ্ধির পেছনে মিঞা আলাউদ্দিন তিনটি সিনেমার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এগুলো হলো রূপবান, বাহরাম বাদশাহ ও বেদের মেয়ে জোসনা।
মিঞা আলাউদ্দিন জানান, ১৯৯৩ সাল থেকে সিনেমা হলের সংখ্যা কমতে থাকে। সে সময় সিনেমার প্রিন্ট করতে খরচ হতো অনেক। কারণ সব ছিল থার্টি ফাইভ মিলিমিটার ফিল্ম। প্রযোজক তার সিনেমার পাঁচটি প্রিন্ট করালে সেটি একে একে ঘুরত সারা দেশের সিনেমা হলগুলোতে।
যারা সারা দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে সিনেমার প্রিন্ট পাঠাতেন তাদেরকে বলা হয় ডিস্ট্রিবিউটর। টাকা খরচ করে সিনেমা নির্মাণ করেন প্রযোজক। প্রযোজকের কাছ থেকে সিনেমাটি নিয়ে সারা দেশে পরিবেশন করেন ডিস্ট্রিবিউটর। আর যারা সিনেমাটি দেখান তারা হলেন হল মালিক বা এক্সিবিটর।
সব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এই পদ্ধতিতেই কাজ চলে বলে জানান মধুমিতা হলের মালিক ও প্রযোজক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই কাজ হচ্ছে। আর এটাই স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম।’
তবে এইখানে ‘বুকিং এজেন্ট’ নামে নামে একটি মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এরা সিনেমা হল মালিকদের কাছে সিনেমা নিয়ে যাবে বলে ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে কমিশন নেয়। আবার সিনেমা পাইয়ে দেবে বলে সিনেমা হল মালিকদের কাছ থেকেও কমিশন নেয়।
ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ পদ্ধতি পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
এসব সমস্যা নিয়েও ৯০ এর দশক পর্যন্ত ভালোই চলেছে সিনেমার ব্যবসা। একবিংশ শতাব্দিতে এসে সিনেমার ব্যবসা নেই বলে মনে করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজকরা।
২০১৯ সালে অর্থাৎ করোনার আগের বছরগুলোতে ক্রমাগত সিনেমা মুক্তির সংখ্যা কমেছে। সেন্সর বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেশে গড়ে মুক্তি পেয়েছে ৪৮টি করে সিনেমা। প্রেক্ষাগৃহ এসে ঠেকেছে ৬০ এ।
সিনেমা নির্মাণে প্রযুক্তির পরিবর্তন এসেছে ঠিক, কিন্তু সে পরিবর্তনে সিনেমার ব্যবসা বাড়েনি। সিঙ্গেল স্ক্রিন বন্ধ হয়েছে বিপুলভাবে আর তার বিপরীতে স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার, সিলভার স্ক্রিনের মতো উন্নত প্রযুক্তির নতুন প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হয়েছে হাতে গোনা ১০টি। এসব স্প্লিট স্ক্রিনে বিদেশি সিনেমা প্রদর্শিত হয়। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত এসব প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ২৬৪টি হলিউড সিনেমা।
তবে চিত্রটি একতরফা চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষয়ের নয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম নামে নতুন একটি ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। হইচই, জি-ফাইভ এর মতো বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি দেশেও তৈরি হয়েছে কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সিনেমা থেকে শুরু করে নানা রকম কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে। সে সংখ্যাও কম নয়।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ১২ মাসে ১২টি কনটেন্ট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমরা আপাতত সেটা পূরণ করছি। আগামীতে অবশ্যেই কনটেন্ট সংখ্যা বাড়বে। আমরা যেমন আশা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি সাড়া পাচ্ছি। একটা উদাহরণ দিলে বুঝবেন, ৩১টি কারেন্সি (৩১ ধরনের বিদেশি মুদ্রা) দিয়ে চরকির সাবস্ক্রিপশন হয়।’
চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদানের সংখ্যা এবং পরিমাণ দুটোই বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬টি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দিয়েছে সরকার।
অনুদান কমিটির সাবেক সদস্য নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুদান এবং অনুদানের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। আমি যখন কমিটিতে ছিলাম, এটা তখন থেকেই বলছিলাম এবং সরকার এটা করেছে এ জন্য ধন্যবাদ। এই বৃদ্ধি করোনার জন্য নয়। এখন থেকে এ পরিমাণেই অনুদান দেয়া হবে।’
দেশে চলচ্চিত্র শিল্পটি ব্যবসা হিসেবে সংকুচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বিশ্ব দরবারে পা রাখা শুরু হয়েছে।
দেশের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। মিশন এক্সট্রিম সিনেমাটি এক সঙ্গে চার মহাদেশে মুক্তি পেয়েছে। ঊনপঞ্চাশ বাতাস টাইমস স্কয়ারসহ কানাডায় প্রদর্শিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রদশিত হচ্ছে বাংলাদেশের সিনেমা।
১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া সূর্য দীঘল বাড়ী সিনেমাটি ১৯৮০ সালে জার্মানির ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসব অংশগ্রহণ করে এবং তিনটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। পর্তুগালের ফিগুএরা দা ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে অর্জন করে একটি পুরস্কার। এ ছাড়া সীমানা পেরিয়ে, মাটির ময়না, স্বপ্নডানায়সহ অনেক সিনেমাই অংশ নিয়েছে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
২০২১ সালে সেই অর্জনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমাটি। এটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অঁ সতেঁ রিগা নামের প্রতিযোগিতা বিভাগ অংশে নেয়া প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা।
এমন ছোট ছোট আরও অনেক অর্জন বাংলাদেশের সিনেমা জগতে যুক্ত হয়েছে গত ৫০ বছরে। তবে আশানুরূপ সিনেমা নির্মাণ না হওয়া, সিনেমা হল কমে যাওয়া এবং সিনেমায় ব্যবসা না থাকায় এসব অর্জন অনেক সময়েই থাকছে চোখের আড়ালে।