হঠাৎ করেই পানির বিল বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। গণশুনানি ছাড়াই একলাফে পানির বিল বাড়ানোকে অন্যায্য বলছেন নগরবাসী। এ নিয়ে প্রতিদিনই সিলেট নগরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন তারা। করপোরেশনের কাউন্সিলররাও অংশ নিচ্ছেন এসব কর্মসূচিতে।
নগরবাসীর এই ক্ষোভের কারণে বিপাকে পড়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সোমবারও বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর সিটি মেয়রের সঙ্গে দেখা করে পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন।
এ অবস্থায় জরুরি সাধারণ সভা ডেকে পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন মেয়র।
সিলেট নগরে খাবার পানি সরবরাহ করে থাকে সিটি করপোরেশন। তবে চাহিদামাফিক পানি সরবরাহ না হওয়ায় নগরের অনেক এলাকায় সংকট লেগে থাকে। পানির সরবরাহ নিশ্চিতের আগেই মূল্য বাড়ানোর কারণে নাগরিকদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
নগরে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ৮ কোটি লিটার। তবে সিটি করপোরেশন প্রতিদিন সাড়ে ৫ কোটি লিটারের মতো পানি সরবরাহ করতে পারে।
নগরের কাজীটুলা এলাকার মিসবাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনমতো পানি পাই না। বাইরে থেকে পানি কিনে ব্যবহার করতে হয়। তবু মাসে মাসে পানির বিল দিচ্ছি। পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও হঠাৎ করে পানির বিল বাড়ানো হয়েছে।’
করপোরেশন বলছে, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণে বিলও বাড়াতে হয়েছে।
করপোরেশনের পানি শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর জানান, প্রতি মাসে পানি উৎপাদন বাবদ গড়ে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ হয়। বিপরীতে গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ টাকা আদায় হয়। আর পানি বাবদ বকেয়া পড়ে আছে ১২-১৩ কোটি টাকা।
তিনি জানান, পানির দাম বাড়িয়ে শতভাগ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা গেলে প্রতি মাসে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা করপোরেশনের কোষাগারে জমা হবে। এভাবে লোকসান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।
সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় গত ২১ জুন পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ২ সেপ্টেম্বর করপোরেশন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানায়। অক্টোবর থেকে গ্রাহকদের বর্ধিত বিল আদায় শুরু করে করপোরেশন।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি মাসে আধা ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের ২০০ টাকার বদলে ৫০০ টাকা দিতে হবে। ৮০০ টাকা দিতে হবে বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি গ্রাহকদের; আগে তারা গুনতেন ৪০০ টাকা।
পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের ৮০০ টাকা গুনতে হবে, যা আগে ছিল ৪০০ টাকা।
বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি গ্রাহকদের বিল ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ৭০০ টাকার বদলে এখন তারা গুনবেন ১২০০ টাকা।
এক ইঞ্চি ব্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে আবাসিক ও সরকারি গ্রাহকদের জন্য ১ হাজার টাকার বদলে দেড় হাজার টাকা দিতে হবে।
দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে ২২০০ টাকা দিতে হবে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের। প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের বিল ১০০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৩০০০ টাকা।
পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রতিনিয়তই মেয়র বরাবর স্মারকলিপি দেয়া, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকাবাসী।
নগরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় সোমবার সকালেও ‘৫ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দের’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়। এতে তিন কাউন্সিলরও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ বলেন, ‘আমরা মাসিক সভা করেই পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেহেতু এই সিদ্ধান্তে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তাই এটি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। নাগরিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েই আমি তাদের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি।’
এ বিষয়ে সোমবার দুপুরে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন ১০ কাউন্সিলর। তাদের একজন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৌফিক বক্স লিপন বলেন, ‘পানির বিল দ্বিগুণ করে ফেলায় নাগরিকদের চাপ বেড়েছে। তারা এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
‘অনেক এলাকার বাসিন্দারা পানি পান না, কিন্তু তাদের বিল দিতে হয়। তাই জরুরি ভিত্তিতে একটি সাধারণ সভা ডেকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।’
এর আগে রোববার বিল বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনের সই করা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে এবং গণশুনানি না করে হঠাৎ পানির বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও অমানবিক।
তাতে আরও বলা হয়, করোনা মহামারির মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে নাজুক, সেখানে তাদের কথা বিবেচনা না করে পানির বিল বাড়ানোর বিষয়টি জনবিরোধীও বটে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পানির দাম না বাড়িয়ে বরং যে পরিমাণ টাকা গ্রাহকদের কাছে বকেয়া আছে, সেগুলো আদায় করা দরকার। নাগরিকদের নামমাত্র মূল্যে পানি সরবরাহ করা উচিত।’
এ বিষয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৫/১৬ বছরে আমরা কোনো ধরনের সেবার দাম বাড়াইনি, কিন্তু এই সময়ে বিদ্যুতের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পানির উৎপাদন খরচে। অন্যান্য সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসাও পানির বিল বাড়িয়েছে। ব্যয় সমন্বয় করতেই আমরা পানির দাম বাড়িয়েছিলাম।
‘যেহেতু এই সিদ্ধান্তে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তাই এই মাসেই সাধারণ সভা ডেকে এটি পুনর্বিবেচনা করা হবে। পানির দাম সহনীয় মাত্রায় আনার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করব। তবে বছরের পর বছর ধরে যারা বিল পরিশোধ করছেন না এবং অবৈধ লাইন ব্যবহার করছেন তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’