‘আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। বিশ্বে আমাদের পরিচিতি বেড়েছে, আমরা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা উন্নতও হয়েছি। কিন্তু আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ, দেশ ও মানুষের সহমর্মিতা, সমবণ্টন এ পর্যায়ে এখনও আসেনি। এ জন্য আরও সোনার মানুষ প্রয়োজন।’
কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান শফিক।
৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে হত্যার শিকার বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মঙ্গলবার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন তিনি।
শফিকুর রহমানের মতো অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারাও সমান অধিকার ও বৈষম্যহীন দেশ দেখার আকাঙ্ক্ষার কথাই বলেছেন।
পরাজয় নিশ্চিত জেনেই স্বাধীনতার উষালগ্নে বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসকদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদররা।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে।
ভারতে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকার আশপাশের এলাকায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখানে যারা (বুদ্ধিজীবীরা) আছেন, তারা ছিলেন দেশের মেধাবী মানুষ। আমরা ক্যাম্পে গিয়েছি, ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছি। তারা দেশে থেকে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের ও সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
৫০ বছরে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির কথা তুলে ধরে একাত্তরের এই বীর যোদ্ধা বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা উন্নত হয়েছি। কিন্তু আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ, দেশ ও মানুষের সহমর্মিতা, সমবণ্টন এ পর্যায়ে এখনও আসেনি। জনগণের সমান অধিকার, সকল সুযোগ-সুবিধা, ন্যায্য বিচার আমরা এখনও দিতে পারিনি। এ জন্য আরও সোনার মানুষ দরকার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার দেশ গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার, আমরা সেই সোনার মানুষ চাই।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর আমি ২৭ মার্চ মা, ভাই, বোনকে নিয়ে লঞ্চে ফতুল্লা হয়ে বিক্রমপুর যাচ্ছিলাম। তখন বুড়িগঙ্গায় দেখলাম অগুণতি লাশ, ফতুল্লা মোড়ে নদীর পাড়ে লাশ কুকুর খাচ্ছে, শকুন খাচ্ছে। সে কী বীভৎস দৃশ্য!
‘পরে আমি ভারত যাই এবং উইপেন (অস্ত্র)-এর ওপর ভারতের মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেই। ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসি। পরে ১১ ডিসেম্বর ঢাকার পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয়। পরে দেখলাম ২০ জনের মতো পাকিস্তানি সৈনিকের লাশ বালু নদীতে ভাসছে। তখন আমার মনে পড়ল ২৭ মার্চ বুড়িগঙ্গায় ভাসা লাশের কথা।’
আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্তরঞ্জন মল্লিক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেয়েদের কাছে, নাতিদের কাছে সব সময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি, কী হয়েছিল, সেসব তুলে ধরি। আমি চাই দেশ আরও এগিয়ে যাক। পরের প্রজন্ম দেশ সম্পর্কে জানুক। এ দেশেকে মন থেকেই ভালোবাসুক, যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন তাদের স্বপ্ন পূরণ হোক। সব মানুষ সমান সুযোগ পাক। ধনী-গরিব, ছোট-বড় যেন না থাকে।’
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আইনজীবী রেহানা পারভীন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবীদের আশা ও লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ আরও আরও উন্নত হবে, আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচব। দেশকে যাতে সবাই মনেপ্রাণে ধারণ করে, এটাই এ দিনে আমার প্রত্যাশা।’
লেখক মাহবুবুর রহমান আরিফ বলেন, ‘বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। এই ব্যর্থতাও কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কারণে হয়েছে। কারণ, বুদ্ধিজীবীরা একটা জাতির ভাষা তৈরি করেন, জাতির দিকনির্দেশনা দেন।’
তিনি বলেন, ‘আজকে মধ্যবিত্তরা কিন্তু তাদের সন্তানকে নিয়ে এখানে (স্মৃতিসৌধে) আসছে না। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছিল তারা সে উৎসাহ তাদের সন্তানকে দিতে পারছে না। আমার রাষ্ট্র গড়ে ওঠার যে ইতিহাস, তার সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর, ২৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চের মতো জাতীয় দিবসগুলোর সঙ্গে শিশু-কিশোরদের পরিচিত করা দরকার। এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ।’
আরিফ বলেন, ‘অতীত গৌরবকে সামনে নিয়ে না আসতে পারি, তাহলে আমাদের সন্তানরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এখানে নিয়ে আসার মধ্য দিয়েই তো তাদের শেখাতে হবে।’