টানা তিন দিনের দরপতনে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তীব্র হচ্ছে। দর কমেছে ঢালাও।
এক দিনের ব্যবধানে লেনদেন আবার হাজার কোটি টাকার ঘর পার হলেও ব্যাংক, বস্ত্র, প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন, আর্থিক, বিদ্যুৎ জ্বালানির মতো প্রধান খাতগুলোতে ব্যাপক দরপতনের কারণে সূচক থেকে হারিয়েছে আরও ৪৪ পয়েন্ট।
এ নিয়ে চলতি সপ্তাহের তিন দিনে সূচক কমেছে ১৪৬.৯৪ পয়েন্ট।
আগের দুই দিন পতনের স্মৃতি নিয়ে মঙ্গলবার লেনদেন শুরু হয় শেয়ার দর বেড়েই। বেলা ১১টা ১২ মিনিটে আগের দিনের চেয়ে ৪২ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল। কিন্তু এরপর শুরু হয় পতন। দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৮৭ পয়েন্ট কমে শেষ হয় লেনদেন।
সূচক পড়লেও লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। আগের দিন আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন দেখে পুঁজিবাজার। হাতবদল হয় ৬৮৩ কোটি ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। সেখান থেকে বেড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৮০ কোটি ৭৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে এখন বিনিয়োগকারীদের হতাশা স্পষ্ট। কী কারণে এই পতন, সেটি বুঝে উঠতে পারছে না তারা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরাও কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের চিত্র
তবে ঘুরেফিরে পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভিন্নতার বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনা শেয়ারের ক্রয় মূল্যে নাকি বাজার মূল্যে হবে, বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না- এ নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে মতভেদের কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে।
গত ৩০ নভেম্বর দুই পক্ষের বৈঠকে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না আসার পর ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় বসে দুই পক্ষকে নিয়ে। সেই বৈঠক শেষেও সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। জানানো হয় ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আরেক দফা বৈঠকের পর দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত আসবে।
সেই বৈঠকের পরদিন বড় পতন হওয়ার পর গণমাধ্যমে খবর আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দুই পক্ষকে নিয়ে বসতে যাচ্ছেন। তবে গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে এই খবরের পর কোনো পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি। এই অবস্থায় রোববার থেকে পুঁজিবাজার আবার যায় দরপতনের ধারায়।
মৌলভিত্তির কোম্পানির দর কমছে আগে থেকেই। স্বল্প মূলধনি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন আদেশের পর তৃতীয় কর্মদিবসে সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকা এবং সবচেয়ে পতনের তালিকা- দুই জায়গাতেই ছিল এই ধরনের কোম্পানি।
বিএসইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা হতে হবে। যেসব কোম্পানির মূলধন ২০ কোটি টাকার নিচে, তারা ছয় মাস, আর যাদের মূলধন ২০ কোটি টাকার কম তারা এক বছর সময় পাবে।
এই সিদ্ধান্তটি আসে বৃহস্পতিবার। আর এর প্রতিক্রিয়ায় রোববার স্বল্প মূলধনি ৬৪টি কোম্পানির মধ্যে দুয়েকটি ছাড়া লাফ দেয় বাকি সবগুলোর দর। কিন্তু সেদিনই বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের একটি বক্তব্য আসে গণমাধ্যমে। তিনি জানান, যারা মূলধন বাড়াতে পারবে না, তাদেরকে ডিএসইর এসএমই বোর্ডে নিয়ে যাওয়া যাবে, যেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অংশই নিতে পারবে না।
এরপর সোমবার আবার স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর ঢালাও দরপতন দেখা দেয়।
তবে মঙ্গলবার দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা। যেসব স্বল্প মূলধনি কোম্পানি মুনাফায় আছে, যেগুলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত, দাম বৃদ্ধির তালিকায় ছিল এমন অনেক কোম্পানি। অন্যদিকে যেসব কোম্পানি লোকসানি, যাদের রিজার্ভ ও সম্পদ ঋণাত্মক হয়ে গেছে, সেগুলো ছিল দর পতনের শীর্ষ তালিকায়।
সূচক পতনে যাদের ভূমিকা বেশি
সূচকের পতনে প্রধান ভূমিকায় ছিল টেলিকমিউনিকেশন খাতের গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির শেয়ার দর ১.১৪ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ৯.৮৩ পয়েন্ট। মোট ৯৬ হাজার ২২৬টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ২ হাজার টাকায়।
সূচক পতনে প্রধান ভূমিকায় থাকা ১০ কোম্পানি
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল একই খাতের আরেক কোম্পানি রবি। ১.৫৪ শতাংশ দাম কমায় সূচক কমেছে ৫.৫৮ শতাংশ।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দর কমেছে দশমিক ৭২ শতাংশ। এতে সূচকের পতন হয়েছে ৪.৫১ পয়েন্ট। কোম্পানিটির ১১ কোটি ৯২ লাখ টাকার ১ লাখ ৮১ হাজার ৯০৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
সূচকের পতনে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের অবদান ছিল ৩.৯৮ পয়েন্ট, কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে দশমিক ৬৩ শতাংশ।
স্কয়ার ফার্মার শেয়ার দর কমেছে দশমিক ৮২ শতাংশ। এতে সূচক কমেছে ২.৪৩ পয়েন্ট।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পাওয়ার গ্রিড ও ইউনাইটেড পাওয়ার, আর্থিক খাতের আইসিবি, ব্যাংক খাতের ওয়ান ও এনআরবিসি সূচক পতনের প্রধান ভূমিকায় ছিল।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচক পড়েছে ৩৫.৯৮ পয়েন্ট।
বিপরীতে সূচক সবচেয়ে বেশি ৩.০৫ শতাংশ বাড়িয়েছে বহুজাতিক ইউনিলিভার। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৫ শতাংশ।
সূচক বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ফরচুন সুজের দাম বেড়েছে ৯.৪৫ শতাংশ, যোগ হয়েছে ২.৩২ পয়েন্ট।
এ ছাড়া লিনডে বিডি, বার্জার পেইন্টস, রেকিট বেনকিনজার, সোনালী পেপার, বাটা শু, ব্র্যাক ব্যাংক, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট ও ডেল্টা লাইফের দর বৃদ্ধিতে সূচক কিছুটা বেড়েছে।
এই ১০টি কোম্পানি মিলিয়ে সূচক বাড়িয়েছে ১৭.৪৮ পয়েন্ট।
এই ১০ কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি
দর বৃদ্ধিতে ১০ কোম্পানি
মঙ্গলবার দর বৃদ্ধিতে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল ফরচুন সুজ, যার শেয়ারপ্রতি দর বেড়েছে ৯.৪৪ শতাংশ। শেয়ার দর ৯৪ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৩ টাকা ১০ পয়সা। ৮৪ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ৮৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে এই কোম্পানি ও চতুর্থ স্থানে থাকা প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ছাড়া বাকি আটটিই স্বল্প মূলধনি। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সবগুলোই মুনাফায় থাকা কোম্পানি, তিনটি আছে বহুজাতিক।
দর বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল এএমসিএল (প্রাণ)। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৮.৭১ শতাংশ। আট শতাংশের বেশি আরও বেড়েছে এপেক্স ফুটওয়্যারের দরও।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের ফার্মা এইডের দর বেড়েছে ৭.৪৯ শতাংশ। সাত শতাংশের বেশি বেড়েছে এপেক্স ফুডের শেয়ার দর।
প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ৬.৬২ শতাংশ বেড়ে শেয়ার দর ৬৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে হয়েছে ৬৯ টাকা ২০ পয়সা। লিব্রা ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৬.৮৬ শতাংশ।
রংপুর ফাউন্ড্রি, বাটা শু, লিনডে বিডি ও সোনালী পেপারের শেয়ার দর বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি। চার শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার দর বেড়েছে সাতটি কোম্পানির।
মঙ্গলবার এই ৬ খাতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ডিএসইতে
দর পতনের ১০ কোম্পানি
দর পতনে থাকা ১০ কোম্পানির মধ্যে চারটি ছিল স্বল্প মূলধনি। এর সব কয়টা লোকসানি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭.৯৭ শতাংশ দর কমেছে লোকসানি শ্যামপুর সুগারের। শেয়ার দর ৯২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৮৫ টাকা ৪০ পয়সা।
জিলবাংলা সুগার মিলের দর ৭.৬২ শতাংশ কমে ১৩৩ টাকা ৭০ পয়সা থেকে হয়েছে ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা। কোম্পানিটির ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ৯ হাজার ১১৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
মেঘনা পেটের শেয়ার দর কমেছে ৬.৮৬ শতাংশ। ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকার ১৯ হাজার ৯৮৭টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে কোম্পানিটির।
ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্কের শেয়ার দর কমেছে ৬.০৬ শতাংশ।
ব্যাংক খাতে গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি উত্থান হওয়া ওয়ান ব্যাংকের পতনও হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। টানা পঞ্চম দিন কমেছে দর। আগের দিন দাম ছিল ১৫ টাকা ৭০ পয়সা। দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ৬০ পয়সা।
কোম্পানিটির মোট ৮ কোটি ৬১ লাখ ৫ হাজার ৫০৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এ ছাড়া জিবিবি পাওয়ারের দর ৬.৩৮ শতাংশ, কাট্টালি টেক্সটাইলের দর ৫.৫৫ শতাংশ, ফাস্ট ফাইন্যান্সের দর ৫.১২ শতাংশ কমেছে।
এ ছাড়া চার শতাংশের মধ্যে শেয়ার দর কমেছে ৫টি কোম্পানির। তিন শতাংশের মধ্যে দর কমেছে ১৫টি কোম্পানির।
এমন কোনো খাত নেই যেটি দরপতনের শিকার হয়নি
লেনদেনে এগিয়ে থাকা ১০ কোম্পানি
দর পতন হওয়া শীর্ষ ১০ কোম্পানিতে থাকলেও ওয়ান ব্যাংকের লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি ১২৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
তারপরই আছে দর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকা ফরচুন সুজ, যার ৮৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩টি শেয়ার হাতবদলের মধ্যে লেনদেন হয়েছে ৮৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে ৩৮ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৯টি শেয়ার। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি দর কমেছে ৩ টাকা ৭০ পয়সা। ১৫৪ টাকা ৪০ পয়সা দরের শেয়ার নেমে এসেছে ১৫০ টাকা ৭০ পয়সায়।
জিএসপি ফাইন্যান্সে ৩৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ডেল্টা লাইফে ২৬ কোটি ৬৮ লাখ, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২১ কোটি ৬১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
১০ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার পর্যন্ত শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৫টি কোম্পানির। ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে একই সংখ্যক কোম্পানির।