আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক বেদনাবিধুর অধ্যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে এ দেশের দোসরদের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
পাকিস্তানি হানাদাররা যখন বুঝতে পারে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, ঠিক তখনই জাতির বরেণ্য সন্তানদের হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে তারা।
স্বাধীনতা পেলেও বাঙালি যাতে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় দেশের সূর্যসন্তানদের।
সেই তালিকায় ছিলেন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে।
পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা ছিলেন সোচ্চার। তারা প্রতিবাদ করেছেন পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা দিয়ে তারা সাহস যুগিয়েছেন পুরো জাতিকে। আর তাই পাকিস্তানি হানাদাররা বিজয়ের ঠিক আগে আগে শেষ আঘাত হিসেবে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে করতে হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়েছে, ভার মুক্ত হয়েছে দেশ, ফিরেছে স্বস্তি। শীর্ষ অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু বিদেশে পালিয়ে থাকায় আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া আলবদর কমান্ডার চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের শাস্তি কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি।
আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা থাকলেও সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণীশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আলাদা বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তার দেয়া বাণীতে বুদ্ধিজীবীদের দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে অসামান্য অবদান রাখেন।
‘বাঙালি জাতি এখনও তার সূর্যসন্তানদের হারানোর শোক হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে’ উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে।’
দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ’৭১-এর ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামাত-মৌলবাদী চক্রের রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে বলে নিজের দেয়া বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে। বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। এসব রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।’
এই ‘কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা রক্ষার চেষ্টা করছে’ তাদেরও একদিন বিচার হবে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিকরোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সশরীরে উপস্থিত থাকবেন না রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তাদের পক্ষে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন তাদের দুই সামরিক সচিব। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবনের প্রেস উইং বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানাবেন শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং যুদ্ধাহত ও উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
মিরপুরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধেও তাদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচিযথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার মধ্য দিয়ে এদিন স্মরণ করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ বছরও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হবে।
এ দিন সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ৮টায় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ৮টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও জানানো হবে ফুলেল শ্রদ্ধা। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে সকাল ৯টায় শ্রদ্ধা জানাবে আওয়ামী লীগ।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনসগুলোর সব স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।