ঢাকা থেকে বরিশালে যাওয়ার সময় লঞ্চের কেবিনে শারমিন আক্তারকে হত্যা করেন তার স্বামী মাসুদ হাওলাদার।
হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর মাসুদ হাওলাদারকে সোমবার ভোরে কক্সবাজারের সুগন্ধা সৈকত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ হত্যার কথা র্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন। মাসুদ ২০১২ সাল থেকে আশুলিয়ার একটি কোম্পানিতে পিকআপের সহকারী হিসেবে কর্মরত।
ভিকটিম শারমিন ১২ বছর ধরে ঢাকার তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়ায় তার চাচার বাসায় থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন।
২০১৯ সালের শুরুতে তাদের পরিচয় হয় এবং বিয়ের আগে ভিকটিম শারমিন বিমানবন্দর থানায় মাসুদের নামে ধর্ষণ মামলা করেছিলেন।
মামলা নিষ্পত্তির জন্য দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর শারমিনের চাচার বাসায় তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা একত্রে না থেকে নিজ নিজ কর্মস্থলের কাছে বসবাস করতেন।
ঢাকা থেকে বরিশালে যাওয়া একটি লঞ্চের কেবিনে শারমিন আক্তারকে হত্যা করেন তার স্বামী মাসুদ হাওলাদার।
মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি শারমিনকে বিয়ে করলেও তার সঙ্গে সংসার করার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু শারমিনকে ডিভোর্স দিতে চাইলেও দেনমোহর বাবদ ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা তার নেই। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঘটনার ১৫-২০ দিন আগে শারমিনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মাসুদ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, লঞ্চের কেবিনে বিষপান ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় শারমিনকে। সকালে এমভি কুয়াকাটা-২ নামের লঞ্চটি বরিশাল নৌবন্দরে পৌঁছলে নিচতলায় কেবিন থেকে এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায় ওই তরুণীর নাম শারমিন আক্তার। তার বাড়ি বরিশালে। ঘটনার পরদিন নিহতের বাবা বাদী হয়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মাসুদকে গ্রেপ্তারের পর সোমবার দুপুরে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, ঘটনার পাঁচ দিন আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার শারমিন সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন। ঘাতক মাসুদ শারমিনের এই অসুস্থতার সুযোগে তাকে কাশির সিরাপের সঙ্গে বিষপান করানোর পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাসুদ চার দিন আগে আশুলিয়া বাজার থেকে চেতনানাশক ওষুধের একটি বোতল কেনেন। তারপর মাসুদ নিজে বরিশালে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাগজ জমা দিতে যাবে বলে শারমিনকে বিভিন্নভাবে ফুঁসলিয়ে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকেন।
৮ তারিখ রাতে শারমিন সামনের সাপ্তাহিক ছুটির কথা চিন্তা করে পরদিন মাসুদের সঙ্গে বরিশালে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যান।
৯ তারিখ বেলা আনুমানিক ১টার দিকে মাসুদ ও শারমিন মিরপুর-১ থেকে বরিশাল যাওয়ার উদ্দেশে বাসে করে সদরঘাট যান।
এর আগে আশুলিয়া বাজার থেকে ৫০ টাকা দিয়ে কাশির সিরাপ কেনেন এবং আগেই কেনা বিষ ও চেতনানাশকের কিছু অংশ কাশির সিরাপের সঙ্গে মিশিয়ে নেন।
খন্দকার আল মঈন জানান, হত্যার সময় যাতে শারমিনের আর্তচিৎকার আশপাশের কেউ কিছু শুনতে না পায়, এই জন্য সে পরিকল্পিতভাবেই বরিশালগামী এমডি কুয়াকাটা-২ লঞ্চের লস্কর কেবিন ভাড়া নেন। লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশে লস্কর কেবিন থাকে বলে কেবিনের ভেতরের কোরো শব্দ বা আওয়াজ বাইরে থেকে শুনতে পারা প্রায় অসম্ভব।
মাসুদের বরাতে র্যাব জানায়, ৯ ডিসেম্বর রাত ৯টার সময় লঞ্চটি বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। লঞ্চ যাত্রা শুরু করার পর মাসুদ তার সঙ্গে থাকা বিষযুক্ত কাশির সিরাপ শারমিনকে খাওয়ান। বিষ খাওয়ার পর শারমিন তিন-চারবার বমি করে অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে যান। এরপর জোরপূর্বক চেপে ধরে বাকি বিষ শারমিনের মুখে ঢেলে পান করতে বাধ্য করান। শারমিন তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় তার পা ছুড়তে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শারমিন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেলে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে লঞ্চের রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে যান মাসুদ।
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে ঘাতক মাসুদ কেবিনের সামনে এসে দেখতে পান যে, শারমিন কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে বিষের বোতলটি কেবিনের মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। মাসুদ তখন পানি দিয়ে কেবিনের দরজার সামনে পড়ে থাকা বিষ পরিষ্কার করে পুনরায় কেবিনে প্রবেশ করেন।
মাসুদের দেয়া তথ্যমতে যখন তিনি কেবিনে প্রবেশ করেন, তখনও শারমিনের শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান ছিল। ঘাতক মাসুদ তখন তার ব্যাগ থেকে শার্ট বের করে নির্মমভাবে শারমিনের শ্বাসরোধে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। লঞ্চ যখন চরমোনাই ঘাটে এসে পৌঁছয়, তখন মাসুদ কেবিন থেকে বের হয়ে লঞ্চের দরজায় অবস্থান নেন। লঞ্চ বরিশাল শহরের ঘাটে এসে পৌঁছলে ঘাতক মাসুদ স্বাভাবিকভাবে লঞ্চ থেকে বের হয়ে সড়কপথে তার নিজ বাড়িতে চলে যান।
লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাটির ব্যাপারে জানাজানি হলে মাসুদ আত্মগোপনের পরিকল্পনা করেন বলে জানায় র্যাব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত সাতটি জেলার (বরিশাল, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করেন। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সহায়তায় র্যাব-১৫-এর একটি দল সোমবার ভোরে ঘাতক মাসুদকে কক্সবাজারের সুগন্ধা সৈকত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।