চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন সাজেক। ৬০৭ বর্গমাইলের এই ইউনিয়নেই রয়েছে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাজেক ভ্যালি।
১৮৮০ সালে ১ হাজার ৭২০ ফুট উচ্চতায় রুইলুইপাড়া তৈরির পর ধীরে ধীরে এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। দূর-দূরান্ত থেকে এখন প্রতিদিনই এখানে আসেন পর্যটকরা।
পর্যটন এলাকা হওয়ায় কিছু স্থানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও সাজেকের স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনমানে তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি। তারা এখনও থাকেন বাঁশের তৈরি মাচাং ঘরে। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলেও তা অপ্রতুল। এ ছাড়া চিকিৎসা, সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রেই অনুন্নতই রয়ে গেছে এ ইউনিয়ন।
সাজেক রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও যেতে হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা রাস্তা দিয়ে। সরেজমিনে গিয়ে পাহাড়ি এ ইউনিয়নবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে সাজেক পর্যটন রিসোর্টে যাওয়ার রাস্তারই উন্নয়ন হয়েছে শুধু, রাস্তার আশপাশের এলাকার উন্নয়ন হয়নি।
সাজেকের ভাইভাই ছড়া, রেদকাটা, করল্যাছড়ি, বালুঘাট, গুলোক মা ছড়া, দীপু পাড়া, গঙ্গারামমুখ, সিজকছড়া, কিচিংপাড়া, ছয়নাছড়া, ৮ নম্বর পাড়া, উলুছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, তামিনীছড়া, ২ নম্বর কালভার্ট, নন্দরাম, নাঙ্গলমারা, টাইগারটিলা, কোগেয়িতলী, এগুজ্যাছড়ি, সাজেকের শিজকছড়া, হিজিংপাড়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনও ছোঁয়া লাগেনি উন্নয়নের।
এ ছাড়া সাজেকের অধিকাংশ এলাকায় নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। নেই উন্নত শিক্ষা। বাসিন্দারা থাকেনও আদিম পদ্ধতির ঘরে। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার ঘরও মেলেনি তাদের ভাগ্যে।
৩৬ নম্বর সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিহীন ও গৃহহীনরা মুজিববর্ষ উপলক্ষে উপহারের ঘর পেলেও ইউনিয়নে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে দুটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছে।
সিজকছড়ার উত্তম কুমার ত্রিপুরা নিউজবাংলাকে জানান, প্রায় ১৭ বছর ধরে এখানে ঘর বেঁধে থাকছেন। এ এলাকায় শিক্ষিতের সংখ্যা খুবই কম। উন্নয়ন বলতে শুধু সাজেক ভ্যালিতে যাওয়ার রাস্তাটি হয়েছে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানিরও অভাব। কেউ প্রধানমন্ত্রীর ঘরও পায়নি।
হিজিংপাড়ার বিপুল ত্রিপুরা জানান, তারা সবাই গরিব। জুমচাষ করলেও আগের মতো ফলন হয় না। আদা ও হলুদ চাষ করে কোনোমতে জীবিকা চালান তারা। সরকারের পক্ষ থেকে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলেই পরিবর্তন হতে পারে।
সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট এলাকার জিকু চাকমা জানান, সাজেকের হাজাছড়া, নোয়াপাড়া, বাঘাইহাট এলাকা এবং ভাইভাই ছড়া বাদে কোথাও তেমন উন্নয়নের দেখা মেলেনি। অধিকাংশ এলাকায় এখনও উন্নয়ন হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে- এমনটা শুনেছিলেন। যারা টাকা দিতে পারেনি তারা ঘর পাননি।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা নিউবাংলাকে জানান, বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। সিজকছড়া, হিজিংপাড়াসহ মাচালং এলাকায় অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। মাটির নিচে পাথর থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
তবে গভীর নলকূপ সম্ভব, কিন্তু অন্যান্য ইউনিয়নে যদি ৬৫টি গভীর নলকূপ পায় তারা বরাদ্দ পান মাত্র পাঁচটি।
সাজেক ইউনিয়ন সবদিক থেকে বৈষম্যের শিকার হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদ, ইউএনও সব ক্ষেত্রে তারা বৈষম্য করে আমাদের বরাদ্দ দেয় না। আমাদের ইউনিয়ন বরাদ্দ না দেয়াতে অনুন্নত রয়ে গেল। শুধু ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ দিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।’
বৈষম্য করায় সাজেক ইউনিয়ন প্রধানমন্ত্রীর উপহার মাত্র তিনটি ঘর পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে সাজেক ইউনিয়নে যতদূর সম্ভব উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তো সাজেকে বেশ উন্নয়ন হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থার জন্যও অনেকবার টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। মাটির ভেতর পাথর হওয়াতে কিছু জায়গায় সম্ভব হচ্ছে না।
‘এ ছাড়া পরিষদেরও কতগুলো সীমাবদ্ধতায় রয়েছে। জেলা পরিষদ যদি ৬০ শতাংশ বরাদ্দ নিজেদের কাছে রাখে তাহলে উপজেলা পরিষদ কীভাবে সেখানে উন্নয়ন করবে।’
উপহার ঘরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা হওয়ায় ওজ্জ্যেংছড়ি, লক্ষ্মীছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় মাত্র ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে পুরো ঘর নির্মাণ সম্ভব নয়। ইট, বালু, সিমেন্ট সবকিছু সেখানে বাজেটের মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই সেখানকার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।’
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য প্রিয়নন্দ চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাজেক ইউনিয়নে সব ধরনের উন্নয়ন করা জরুরি। তাদের স্থানীয় গণ্যমান্য কিংবা যারা সৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত নন তারা যদি যোগাযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই সেখানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’