স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোকে নিয়ে পুঁজিবাজারে কারসাজি বন্ধ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এমন এক নির্দেশ দিয়েছে, যেটি বাজারে নতুন করে কারসাজির সুযোগ করে দিতে পারে।
সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতিটির পরিশোধিত মূলধন হতে হবে অন্তত ৩০ কোটি টাকা। এ জন্য সর্বোচ্চ এক বছর সময় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে যেসব কোম্পানির মূলধন ২০ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি, তারা সময় পাবে ছয় মাস।
মূলধন বাড়াতে বিএসইসি তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছে। ১. বোনাস শেয়ার ইস্যু, ২. রাইট শেয়ার ইস্যু, ৩. রিপিট আইপিও। কিন্তু এমন অনেক কোম্পানি আছে, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিয়ে আসছে। সেগুলোর রিজার্ভেও কোনো টাকা নেই, শেয়ারপ্রতি সম্পদ নেই, উল্টো দায় তৈরি হয়েছে। এমন সব কোম্পানির পক্ষে বোনাস, রাইট বা রিপিট আইপিও করা সম্ভব নয়।
আবার যেসব কোম্পানি যুগ যুগ ধরে ব্যবসা করতে পারেনি, আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেনি, তারা কীভাবে এক বছরের মধ্যে নিজেদের পাল্টে ফেলবে- এমন প্রশ্নও উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে বিএসইসির বক্তব্য হচ্ছে, যারা পারবে, তাদের তারা মূল বাজারে রাখবে। বাকিদের এসএমই বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে সবাই লেনদেন করতে পারে না, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই লেনদেন করে।
এসএমই বোর্ডে এখন পর্যন্ত ছয়টি কোম্পানি আছে। মূল বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে সেখানকার কোম্পানিগুলোর শেয়ারগুলো এত বেশি নয়। নতুন তালিকাভুক্ত দুটি কোম্পানি তিন মাসের মধ্যেই অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে।
বৃহস্পতিবার মোট ৬৪টি কোম্পানিকে বিএসইসি থেকে চিঠি দেয়া হয় পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে। রোববার প্রথম কর্মদিবসেই এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া দর বেড়েছে বাকি সবগুলোর। বেশ কয়েকটি কোম্পানির দর বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
প্রশ্ন উঠেছে, পরিশোধিত মূলধন বাড়ালেই কি সব কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যাবে?
সব কোম্পানি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, এ বিষয়ে সংশয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভীও। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক কোম্পানি আছে, সেগুলোর রিজার্ভেও পর্যাপ্ত টাকা নেই। রিজার্ভে টাকা না থাকলে সে কোম্পানি বোনাসও দিতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘লোকসানি কোম্পানিগুলোকে যখন পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর চিঠি দেয়া হয়, তখন বিনিয়োগাকারীদের মধ্যেও এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়, যার প্রভাব রোববার দেখা গেছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের কোম্পানিগুলো পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে পারবে কি পারবে না, সেটি বিবেচনা করে শেয়ার কেনা উচিত ছিল।
‘এ কোম্পানিগুলো যদি পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে মূল বোর্ডে থাকতে পারে তাহলে ভালো, যদি না থাকতে পারে তাহলে লোকসানের ভার বিনিয়োগকারীদেরই নিতে হবে।‘
কী বলছে বিএসইসি
বেশ কিছু লোকসানি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের কাছে প্রশ্ন রাখলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আমরা এখন একটি প্রস্তাবনা পাব। তারা কীভাবে কী করতে চায়, সে বিষয়গুলো আমাদের জানাবে। তারপর আমরা বিবেচনা করব।
‘কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন যদি একেবারেই বাড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা তাদের স্মলক্যাপ বা এসএমই বোর্ড আছে, সেখানে স্থানান্তর করে দেব।’
বিএসইসির চিঠির পরই প্রায় সব কয়টি ছোট মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো বিনিয়োগকারীকে কোনো কোম্পানির শেয়ার না কিনতে বলতে পারি না। বিনিয়োগকারীরাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এটা একেবারেই তাদের নিজস্ব ইচ্ছা।’
টানা লোকসানি কোম্পানি
জিলবাংলা সুগারের পরিশোধিত মূলধন ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেয়ারসংখ্যা ৬০ লাখ। গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ১১৫ টাকা ৯৭ পয়সা হিসাবে কোম্পানিটি লোকসান দিয়েছে ৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ২০ হাজার টাকা।
তার আগের বছর শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৯৩ টাকার বেশি। এই হিসাবে মোট লোকসান দাঁড়ায় ৫৬ কোটি টাকার বেশি। তার আগের বছর শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ১০৩ টাকার বেশি, এই হিসাবে লোকসান দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকার মতো।
রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক চিনিকল শ্যামপুর সুগারের পরিশোধিত মূলধন আরও কম। কিন্তু লোকসান আরও বেশি। ৫ কোটি টাকা মূলধনের এই কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা ৫০ লাখ। গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ১২৫ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে লোকসান দিয়েছে ৭৫ কোটি টাকার বেশি।
১ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের জুট স্পিনার্স গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ৪৪ টাকা ৫৯ পয়সা। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি কোনো সম্পদ নেই, উল্টো শেয়ারপ্রতি দায় আছে ৩৯৩ টাকা ৫৭ পয়সা।
১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি উসমানিয়া গ্লাস তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেসরকারি কোম্পানির কাছে দাঁড়াতেই পারছে না। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ক্রমেই বাড়ছে।
২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ২১ পয়সা, গত অর্থবছরে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটির কর্মকর্তারা নিজেরাও জানেন না কবে মুনাফার মুখ দেখা যাবে। তারা গণমাধ্যমকে একাধিকবার বলেছেন, যে ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা কাজ করেন, সেগুলো এই যুগে আর চলে না। ফলে সেটি আধুনিকীকরণ করা ছাড়া উপায় নেই।
পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে ৩০ কোটি টাকা করলে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি টাকা এক অর্থবছরেই লোকসান হয়ে যাচ্ছে তাদের।
বিবিধ খাতের কোম্পানি সাভার রিফ্রাকটরিজ কখনও লভ্যাংশ দিয়েছে, এমন তথ্য নেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে। কিন্তু ১ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের এই কোম্পানিটির শেয়ারদর বিস্ময় জাগায়। সাম্প্রতিক সময়ে দর অনেকটা কমলেও বুধবার লেনদেন হয়েছে ১৮৭ টাকা ৭০ পয়সা। তবে গত এক বছরে সর্বোচ্চ দর ৩০৮ টাকা ৭০ পয়সা।
একই খাতের আরেক কোম্পানি দুলামিয়া কটন কখনও লভ্যাংশ দিতে পেরেছে, এমন তথ্য নেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে। প্রতিবছরই লোকসান দেয়া কোম্পানিটি ২০২১ সালেও শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৩৭ পয়সা লোকসান দিয়েছে।
ক্রমাগত লোকসানের কারণে রিজার্ভ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দায় তৈরি হয়েছে। শেয়ারপ্রতি সম্পদও দায়ে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালে এই দায় দাঁড়িয়েছে ৩৭ টাকা ৪২ পয়সা।
৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইমাম বাটন ২০১৪ সাল থেকেই টানা লোকসানে বলে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেখা যায়। ২০১০ সালে সবশেষ ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে তারা।
১৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের মেঘনা কনডেনড মিল্ক গত এক যুগেও লভ্যাংশ দিতে পারেনি প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণে। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৮ টাকা ২৬ পয়সা। ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছরই এই লোকসান শেয়ারপ্রতি ছিল ৭ টাকার বেশি।
একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজও এক যুগ ধরে টানা লোকসান দিচ্ছে। এই কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১২ কোটি টাকা।
৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের জিকিউ বলপেনের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ১ টাকা ১৫ পয়সা। সেটি গত অর্থবছরে গিয়ে ঠেকে ৭ টাকা ৫৬ পয়সা।
কোম্পানিটির সমস্যা যে অর্থের নয়, তা তাদের রিজার্ভেই স্পষ্ট। সেখানে ৯৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা হাতে আছে, অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি ১১০ টাকার বেশি। শেয়ারপ্রতি সম্পদ আছে ১৩৮ টাকা ৭৯ পয়সার। কোম্পানিটির সমস্যা হলো তারা যে ধরনের ব্যবসা করে, সেটির এখন চাহিদা নেই।
মুনাফার মুখ কমই দেখে এসব কোম্পানি
১৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের হাক্কানি পাল্প গত ছয় বছরের মধ্যে পাঁচ বছরই লোকসান দিয়েছে। ২০২০ সালে মুনাফায় ফিরলেও শেয়ারপ্রতি আয় ছিল কেবল ৭ পয়সা। তবে গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে আবার শেয়ারে ১ টাকা ২৮ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও শেয়ারপ্রতি ৪৯ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি।
১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের সমতা লেদারের আয়, লভ্যাংশ- দুটিই হতাশাজনক। ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ১০ পয়সা আয় করে ৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি।
২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ২৮ পয়সা আয় করে ২০ পয়সা লভ্যাংশই ছিল গত এক দশকের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ।
আলোচিত ব্যবসায়ী পি কে হালদারকাণ্ডে নাম আসা নর্দার্ন জুট গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের হিসাব এখনও প্রকাশই হয়নি। কেবল ২০০২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব প্রকাশ হয়। ওই সময়েই শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৬ টাকা ২৪ পয়সা। এর পরের তিন প্রান্তিকের হিসাব কবে প্রকাশ হবে, সেটিও অজানা।
সিরামিক খাতে স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের পরিশোধিত মূলধন ৬ কোটি ৪৬ পয়সা। এই কোম্পানিটি গত ছয় বছরের চার বছর সামান্য মুনাফা করে দুই বছর লোকসান করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৩৩ পয়সা।
বছর ছয়ের আগে কোম্পানিটি বেশ ভালো করবে, এমন গুজবে শেয়ার দর ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু পরে আয়ে কোনো চমক দেখাতে পারেনি। ভবিষ্যৎ এমন কোনো পরিকল্পনাও তারা জানায়নি, যা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।
৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি বিডি অটোকার গত এক যুগে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫৩ পয়সা আয় করতে পেরেছিল। তার আগের বছর আয় ছিল ১ টাকা ৫২ পয়সা। বাকি প্রতিবছরই আয় ১ টাকার কম ছিল।
কোম্পানিটির শেয়ার ২ টাকাতেও লেনদেন হয়েছে একসময়। ২০১৭-১৮ সালে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেখান থেকে কমে এখন দাম ১৫০ টাকার কাছাকাছি।
শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ৮৫ পয়সা সম্পদ থাকা কোম্পানিটি ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি আয় করতে পেরেছে ৩৭ পয়সা। অর্থাৎ এটি ব্যবসা বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়ে উল্টো আগের চেয়ে খারাপ করেছে।
৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের আজিজ পাইপ গত ছয় বছরেও কখনও শেয়ারপ্রতি ১ টাকা আয় করতে পারেনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৪১ পয়সা লোকসান দিয়ে পরের পাঁচ বছরেও সম্মিলিত আয়ও তা ছাড়ায়নি।
২০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের রহিমা ফুড তাও গত বছর মুনাফায় ফিরেছে। শেয়ারপ্রতি ৭ পয়সা হিসেবে মুনাফা হয়েছে ২৮ লাখ টাকা। তবে কোম্পানিটি নতুন করে নারকেল তেলের ব্যবসায় নামার প্রস্তুতি নিয়েছে এবং একে কেন্দ্র করে শেয়ারদর বাড়ছে।
২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ৮৩ পয়সা লোকসান কাটিয়ে মুনাফায় ফেরা জেমিনি সি ফুডের পরিশোধিত মূলধন ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিটির ২০১৭ সাল পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১৫ টাকার বেশি আয় দেখাতে পারলেও পরের দুই বছর তা থাকে ১ টাকার কম।
নগণ্য আয়
১৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি ফাইন ফুডস গত এক দশকেও কখনও শেয়ারপ্রতি ১ টাকা করে আয় করতে পারেনি।
২ কোটি ৭১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের সোনালী আঁশ গত ছয় বছরের মধ্যে কোনো বছরই শেয়ারপ্রতি ২ টাকাও আয় করতে পারেনি।
৭ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের বঙ্গজও ব্যবসা বাড়াতে পারছে না। গত ছয় বছরে দুই বছর লোকসান ও চার বছর অল্পবিস্তর মুনাফা করতে পেরেছে কোম্পানিটি। ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ২৩ পয়সা আয় করা কোম্পানিটি চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে লোকসান দিয়েছে ১২ পয়সা।
৪ কোটি ৯০ লাখ ৩ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কে অ্যান্ড হক গত ছয় বছরেও কখনও শেয়ারপ্রতি এক টাকাও আয় করতে পারেনি। বছর কয়েক আগে শ্রীলঙ্কান কোম্পানি যুক্ত হবে- এমন গুঞ্জনে শেয়ারদর ১ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু পরে সেটি সত্য প্রমাণ হয়নি। গত চার বছরে শেয়ারপ্রতি সর্বোচ্চ ৭৫ পয়সা লভ্যাংশ পেয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
২ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের অ্যামবি ফার্মার ব্যবসা বাড়ছে না, উল্টো কমতে কমতে ২০২১ সালে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেও শেয়ারে ১০ পয়সা মুনাফা করতে পেরেছে কেবল তারা।
ক্রমেই খারাপ হচ্ছে আয়
বছর ছয়েক আগেও বস্ত্র খাতের সবচেয়ে ভালো কোম্পানির একটি হিসেবে পরিচিত ছিল স্টাইলক্রাফট। শেয়ারসংখ্যা ছিল খুবই কম। শেয়ারদর থাকত ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে। ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৫২ টাকা ১৭ পয়সা।
তবে ২০১৮ সালে ৪১০ শতাংশ, পরের বছর আরও ১৫০ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ বোনাস দিয়ে ১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি এখন ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূলধনের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
তবে মূলধন বাড়িয়ে কোম্পানিটি এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আর্থিক সংকটে, এমনকি শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বন্ধ। বকেয়া পরিশোধ করে গত আগস্টে কোম্পানি চালুর ঘোষণা দিয়েও তারা তা পারেনি।
গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৯৩ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটি চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে লোকসান দিয়েছে ২ টাকা ৫ পয়সা।
৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি আরামিটের ব্যবসাও নিম্নমুখী। ২০১৮ সালেও শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা ২০ পয়সা আয় করতে পেরেছিল কোম্পানিটি। পরের দুই বছর আয় হয় যথাক্রমে ৩ টাকা ২৭ আর ৩ টাকা ৩৬ পয়সা। দুই বছর পর গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে কিছুটা ঘুরে শেয়ারপ্রতি ৭ টাকা ৬৯ পয়সা আয় করতে পারে কোম্পানিটি।
৯ কোটি ৪৬ টাকা পরিশোধিত মূলধনের রহিম টেক্সটাইলের আয় কমছে ২০১৬ সাল থেকে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত আয় কমলেও ওই বছরও শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৬ টাকা ৩৪ পয়সা। তবে পরের বছর তা একেবারেই কমে দাঁড়ায় ৭৫ পয়সায়। ২০২১ সালে কিছুটা বেড়ে হয় ২ টাকা ২৫ পয়সা।
৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের দেশ গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ২০১৬ সালে শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ৪৬ পয়সা আয় ছিল কোম্পানিটির। কমতে কমতে ২০২০ সালে দাঁড়ায় শেয়ারপ্রতি ৪৩ পয়সা। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ২৬ পয়সা।
৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এপেক্স স্পিনিং মিলস পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালেও শেয়ারপ্রতি যত টাকা আয় করেছে, সেটিও আর করতে পারেনি। ব্যবসা বাড়ানো দূরের কথা, তারাও ধীরে ধীরে অবস্থান হারিয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩ টাকা ৪২ পয়সা। গত বছরের চেয়ে ভালো করেও ২০২১ সালে সেখান থেকে কম শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৯৩ পয়সা আয় করতে পেরেছে কোম্পানিটি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়াকে কেন্দ্র করে মুন্নু স্টাফলারের শেয়ারদর ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে। সে সময় কোম্পানিটি কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবসায় নামবে জানিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে আশার সঞ্চার করে। পাল্টানো হয় কোম্পানির নামও। নতুন নাম রাখা হয় মুন্নু অ্যাগ্রো অ্যান্ড জেনারেল মেশিনারিজ।
কিন্তু ওই বছর এবং পরের বছর ২০ শতাংশ, তার পরের বছর ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পরও এখন পরিশোধিত মূলধন ২ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
২০১৭ সালে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৫৯ লাখ টাকা মাত্র।
৩৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার আগের বছরে অর্থবছর একসঙ্গে দেড় বছরের হিসাব দেয় কোম্পানিটি। তখন শেয়ার প্রতি ৩ টাকা ২১ পয়সা আয় করার কথা জানায় কোম্পানিটি। ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ৫৫ পয়সা। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয় হয়েছে ৩৬ পয়সা।
১৪ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের ওয়াটা কেমিক্যালের আয় দুই বছর থেকে ক্রমহ্রাসমান। ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ১১ টাকা ৫৩ পয়সা আয় করা কোম্পানিটি ২০২১ সালে আয় করেছে ৬ টাকা ১৪ পয়সা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের ৫০ শতাংশ কম।
২২ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের জেএমআই সিরিঞ্জে জাপানি বিনিয়োগের তথ্যে কয়েক বছর আগে শেয়ারদর ব্যাপকভাবে বাড়লেও কোম্পানিটির ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়নি, বাড়েনি আয়ও। উল্টো গত বছর করোনার সময় মাস্ক কেলেঙ্কারিতে নাম আসে কোম্পানিটির।
২০১৬ সালেও কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি আয় করতে পারে ৮ টাকা ৮৮ পয়সা, সেটি ২০২১ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৩ পয়সা।
১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের বাটা শু কোম্পানি হিসেবে ভালো, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তাদের ব্যবসায়িক গ্রাফটা নিম্নমুখী। ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমাগতভাবে কমছে আয়। ওই বছর শেয়ারপ্রতি ৮২ টাকা ৩৪ পয়সা আয় করা কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৯৬ টাকা ৯৪ পয়সা লোকসান করে বসে।
ডিসেম্বরে অর্থবছর শেষ করা কোম্পানিটি গত জুন পর্যন্ত মুনাফায় ফেরার আশা দেখালেও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ারপ্রতি আবার ৮ টাকা ৩৬ পয়সা লোকসান দিয়ে বসে। নয় মাসে শেয়ারপ্রতি ১০ টাকার বেশি লোকসান দেয়া কোম্পানিটি অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে চমক না দেখালে টানা দ্বিতীয় বছর লোকসানে থেকে যাবে।
১ কোটি ৫০ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের লিবরা ইনফিউশনও ব্যবসা খুইয়েছে। ২০১৫ সালেও শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৪৪ পয়সা আয় ছিল। টানা তিন বছর বেড়ে ২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৫ টাকা ১ পয়সা। ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫ পয়সা আয় দেখানোর পর দুই বছর আর হিসাবই দেয়নি।
১৩ কোটি ৮০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের লিগ্যাসি ফুটওয়্যার ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৪৬ পয়সা আয় করলেও পরের বছর লোকসান দেয় ৭ টাকার বেশি। ২০২১ সালে আয় হয় ৩৯ পয়সা।
কোম্পানি ‘ভালো’, আয় কম
প্রকৌশল খাতের বিডি ল্যাপস এই খাতের একটি মানসম্মত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত। ফিলিপস বাতি উৎপাদন করে নাম করা কোম্পানিটি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা বাড়াতে পারেনি।
৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি ২০১৬ সালেও শেয়ারপ্রতি ৪ টাকা ২০ পয়সা আয় করতে পারে। ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ৮৮ পয়সা লোকসান দেয় তারা। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আয় করতে পারে ৫ টাকা ১০ পয়সা।
৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এএমসিএল প্রাণ এক যুগেও তাদের ব্যবসা বাড়াতে পারেনি। লভ্যাংশও শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ২০ পয়সায় স্থির বহু বছর ধরে। গত সাত বছরে শেয়ারপ্রতি আয় ৬ থেকে ৭ টাকায় স্থির।
১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের রংপুর ফাউন্ড্রি তার ব্যবসা বাড়াতেই পারছে না। লভ্যাংশও বাড়ছে না। অর্থবছর পাল্টানোর পর ২০১৬ সালে দেড় বছরের জন্য ৩৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার পর প্রতিবছরই লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে ২৩ শতাংশ করে।
এই সময়ে কোম্পানিটির আয়ও ঘুরে ফিরে একটি বৃত্তেই ছিল। শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ১১ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৩ টাকা ৯২ পয়সা আয় করতে পেরেছে কোম্পানিটি। ২০১৬ সালে দেড় বছরে আয় ছিল ৫ টাকা ৫১ পয়সা।
৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এপেক্স ফুডও ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে গত সাত বছরে। ২০১৬ সালে শেয়ার প্রতি ২ টাকা ৩২ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটি পরের ৫ বছর মুনাফাতেই ছিল। কিন্তু কোনো বছরই মুনাফা ২ টাকা ৭ পয়সার বেশি হয়নি।
১৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এপেক্স ট্যানারিও তাদের আয় বাড়াতেই পারছে না। ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৯৫ পয়সা আয় করা কোম্পানিটি ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১৯ পয়সা লোকসান দিয়ে বসে। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে মুনাফায় ফিরলেও আয় করতে পারে কেবল শেয়ারপ্রতি ৩৪ পয়সা।
১১ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবসাও বাড়ার বদলে সংকুচিত হচ্ছে। ২০১৮ সালেও শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১১ টাকা ৫৪ পয়সা। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আয় করতে পারলেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১০ টাকার নিচে।
আয় ভালো, তবে মূল ব্যবসা থেকে না
১৫ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ারদর গত দুই বছরে সর্বনিম্ন ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৪৮৩ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তবে শেয়ারদর যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে কোম্পানির আয় বাড়েনি। ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ১ টাকা ৯৩ পয়সা, ২০২১ সালে তা দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯৩ পয়সা।
কোম্পানিটি চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকার বেশি আয়ের কথা জানালেও সেটি তাদের মূল ব্যবসা থেকে ছিল না। শেয়ার থেকে আয়ের কারণে ব্যবসা বেড়েছে।
২১ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের সোনালী পেপার ২০২১ সালে শেয়ারপ্রতি ৪ টাকা ৮৯ পয়সা আয় করার পর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি ৬ টাকা ৬৬ পয়সা আয় দেখায়। তবে পরে জানা যায়, দুই বছরের আয়ের বেশির ভাগই তাদের মূল ব্যবসা থেকে আসেনি। শেয়ারে বিনিয়োগ থেকেই এসেছে এই আয়।
কাগজ খাতে ওটিসি ফেরত আরও কোম্পানিকেও বাড়াতে বলা হয়েছে পরিশোধিত মূলধন।
এদের মধ্যে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের মনোস্পুল পেপার দীর্ঘ এক যুগ ওটিসিতে কাটিয়ে মূল মার্কেটে ফিরেছে চলতি বছর। এর আগের দুই বছর ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৯১ পয়সা এবং পরের বছর ৯ টাকা ১০ পয়সা মুনাফা দেখিয়েছে। তবে গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে ১ টাকা ২৩ পয়সা।
চলতি অর্থবছর শেয়ারপ্রতি ২৩ পয়সা আয় দেখানো কোম্পানিটি ব্যবসা যে বাড়াতে পারছে না, সেটিই স্পষ্ট করেছে।
আরেক কোম্পানি পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এক যুগ পর মূল মার্কেটে ফেরার আগে ২০১৯ সালে ৭৯ পয়সা ও ২০২০ সালে ১ টাকা ৬৯ পয়সা আয় দেখায়। মূল মার্কেটে ফেরার বছরে তারা আয় দেখায় শেয়ারে ১ টাকা ৩৪ পয়সা।