সংবাদ প্রকাশের জেরে প্রেস ক্লাব গাইবান্ধার যুগ্ম সম্পাদক ও নিউজবাংলার গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি পিয়ারুল ইসলামের নামে যে মামলা হয়েছে, সেই মামলার প্রতিবাদে তদন্ত সংস্থায় স্মারকলিপি জমা পড়েছে।
জেলা পিবিআই কার্যালয়ে রোববার দুপুরে প্রেস ক্লাব গাইবান্ধার পক্ষ থেকে এ স্মারকলিপি দেয়া হয়। পিবিআই পুলিশ সুপারের পক্ষে স্মারকলিপিটি নেন ইন্সপেক্টর আব্দুস সবুর।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রেস ক্লাব গাইবান্ধার সভাপতি খালেদ হোসেন, সিনিয়র সহসভাপতি রবিন সেন, সহসভাপতি মিজানুর রহমান রাজু, সাধারণ সম্পাদক জাভেদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক রিপন আকন্দ, তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক লাল চাঁন বিশ্বাস সুমন, কার্যকরী সদস্য শাহজাহান সিরাজ, ওবাইদুল ইসলাম, রুবেল প্রমাণিক, সোহেল রানাসহ আরও অনেকে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে এক রিকশাচালককে নির্যাতন ও পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর ঘটনায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় পিয়ারুল ইসলামকে নারী নির্যাতনের একটি মামলায় আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপংকর সরকার সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছেন। এসআই দীপংকর সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ দক্ষ অফিসারের মাধ্যমে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করার দাবিও জানানো হয়।
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে গত জুনে ছকু মিয়া নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয় নির্যাতনে। নিহতের ছেলে মোজাম্মেল হক মামলায় অভিযোগ করেন, স্থানীয় দাদনকারবারির ছয় ভাই ১৫ মে হাত-পা বেঁধে রাতভর পিটিয়ে তার বাবার হাত-পা ও দাঁত ভেঙে দেয়।
অভিযোগে বলা হয়, ওই দাদনকারবারিদের সঙ্গে ছকু মিয়ার দাদনের টাকা নিয়ে পুরোনো বিরোধ ছিল। ছকুর ছেলে মোজাম্মেলের সঙ্গে দাদনকারবারি মন্টু মিয়ার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক জানতে পেরে মন্টু তার ভাইদের নিয়ে ছকুকে রাতভর নির্যাতন করে।
আলমগীর, আংগুর, রনজু, মনজু, সনজু ও মন্টু মিয়া রাতভর ছকুকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে কোনো চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে পরদিন ১৬ মে দিনভর তাকে জিম্মি করে রাখে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
এক সপ্তাহ পর দামোদরপুর ইউপি চেয়ারম্যান এ জে এম সাজেদুল ইসলাম স্বাধীনের উপস্থিতিতে সালিশ বৈঠকে ‘ছেলের প্রেমের খেসারত’ হিসেবে ছকু মিয়াকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই টাকার জন্য ছকুর একমাত্র ঘরটিও ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন দাদনকারবারিরা। এরপর তাকে ভিটেছাড়া করা হয়। পরে ছকু মিয়া আশ্রয় নেন গাজীপুরের শ্রীপুরে ছেলের বাসার। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ জুন মৃত্যু হয় তার।
পরে ছকুর ছেলে মোজাম্মেল বাবা হত্যার মামলা করতে চাইলে থানায় তার মামলা নেয়া হয়নি। উল্টো মোজাম্মেল ও তার বোনকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে ওই ছয় ভাই।
পরবর্তী সময়ে গত ১৬ জুন ছকু মিয়ার ছেলে মোজাম্মেল হক জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে (সাদুল্লাপুর) মামলা করেন। মামলায় ছয় ভাই আলমগীর, আংগুর, রনজু, মনজু, সনজু, মন্টুসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। পরে আদালতের বিচারক শবনম মুস্তারী সাদুল্লাপুর থানাকে মামলা রেকর্ডভুক্ত করে ২৩ জুনের মধ্যে মরদেহ উত্তোলন ও ময়নাতদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।
পুরো ঘটনায় শুরু থেকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
আদালতের এই নির্দেশনা পাওয়ার পরই ছকু হত্যার প্রধান আসামি মন্টু মিয়ার স্ত্রী বাদী হয়ে তাদের মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে গাইবান্ধা নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে ছকুর ছেলে মোজাম্মেল, নিউজবাংলার গাইবান্ধা প্রতিনিধিসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সাক্ষী হন ছকু হত্যা মামলার নয় আসামি।
এজাহারে বলা হয়, চলতি বছরের ১৫ মে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের ওই তরুণীকে মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক পিয়ারুল ইসলাম, তার ছোট ভাই ওয়ারেস সরকার, চাচা আসাদুল ইসলাম, একরামুল হক ও তার ছোট ভাই ইউসুপ আলী বাড়ির অদূরে একটি ব্রিজের সামনে থেকে অপহরণ করে। পরে মোজাম্মেল তরুণীকে ঢাকার গাজীপুরে নিয়ে আটকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন।
গত ২৮ জুলাই মামলার আবেদনটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ৪ নভেম্বর মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক পিয়ারুল ইসলাম, চাচা আসাদুল ইসলাম ও একরামুল হকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন গাইবান্ধা পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই দীপংকর সরকার। প্রতিবেদনে মোজাম্মেল হককে অপহরণ ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া বাকি তিনজনকে অপহরণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
রিকশাচালক ছকু হত্যাকাণ্ডের আসামিরাই নারী নির্যাতন মামলা সাক্ষী।
এই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের কোনো আলামত মেলেনি শারীরিক পরীক্ষায়। তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি এসেছে নিউজবাংলার হাতে। সেখানে শারীরিক পরীক্ষার বরাত দিয়ে চিকিৎসকের মন্তব্য লেখা হয়েছে: ‘নো সাইন অফ ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স।’
তদন্ত কর্মকর্তার কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তুলছে গ্রামবাসী। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দীপংকর সরকার তার তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা পাওয়া কথা উল্লেখ করলেও তিনি কোনো ঘটনার আলামত জব্দ করতে পারেননি। এ ঘটনায় ভিকটিমের ১৬১ ধারায় স্বীকারোক্তি, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও গ্রামবাসীর জিজ্ঞাবাদের ভিত্তিতে তিনি ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তদন্ত কর্মকর্তা মামলার আসামি মোজাম্মেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠান। সে সময় মোজাম্মেলের সঙ্গে গ্রামের আরও কয়েক ব্যক্তিও পিবিআই কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় তদন্ত কর্মকর্তা তাদের কাছে ঘুষ চেয়েছিলেন এমন অভিযোগ করছেন তারা, কিন্তু ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে আসামিপক্ষ কিংবা গ্রামবাসীর কোনো মতামত নেননি ওই তদন্ত কর্মকর্তা।
এ নিয়ে গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'ওই পুলিশ (তদন্তকারী কর্মকর্তা) মন্টু (টাকা) চাইছিল ১৫ হাজার। হামরা কিসক মন্টু দিমো? হামার তো অপরাধ নাই। সেই তেকনে (ঘুষ না দেয়া) ওমার ঠাই (বাদীপক্ষ) টেকা খায়া এগুলা করছে পুলিশ। এটা কোন বিচার হইলো?’
সেদিন একই গ্রামের ভ্যানচালক মধু মিয়াও যান পিবিআই অফিসে। তিনি বলেন, 'একে একে সব শুনছে। আসার আগে হাত দিয়ে টেকার ইশারা করে পুলিশ। হামরা কছি, সত্যের পথে ফাঁসি হোক। টেকা দিবের পাব না।'
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা দীপংকর সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্তের সময় ভিকটিম ১৬১ ধারায় ঘটনার সত্যতা আমাদের নিশ্চিত করেছে, পরে সে আবার আদালতেও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। একাধিক গ্রামবাসী ও সাক্ষীর জবানবন্দি রয়েছে। আমি তদন্তে যা পেয়েছি তাই তুলে ধরেছি। বাকিটা আদালত দেখবেন।’
গ্রামবাসীর কাছে ঘুষ চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অসম্ভব, এমন কিছু হয়নি।’
এদিকে যে তরুণীকে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং ছকুর ছেলে মোজাম্মেলের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক। এই স্বীকারোক্তির মোবাইলে ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজ হাতে এসেছে নিউজবাংলার।
ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রামবাসীকে ওই তরুণী বলছেন, ‘দুই-তিন বছর ধরে মোজাম্মেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আমার। আমাক কেউ অপহরণ, ধর্ষণ করে নাই। বাপ, চাচা, জ্যাঠা প্রতিদিন আমাকে মারধর করত। মোজাম্মেলকে মারার হুমকি দিত। আমি তো নিরুপায় হয়ে পুলিশের কাছে ও গাইবান্ধা আদালতে মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছি।’
পরবর্তী সময়ে আদালতে গেলে সত্য বলবে বলেও জানান তরুণী।
ছকু হত্যা মামলাটির কার্যক্রম ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই মামলাটি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেনও। সেই সঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঘটনাটি জনসমক্ষে আনায় নিউজবাংলার প্রতিবেদকের ওপর ক্ষোভ জন্মানোয় তাকেও পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে সেই মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমার মক্কেল মোজাম্মেল একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বাদী। এ ছাড়া আরেকজন মামলাটির সাক্ষী। আর সাংবাদিক পিয়ারুল নির্যাতিত ছকুকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ঘটনাটি ফলাও করে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করে। যা দেখে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাটি জেলাজুড়ে আলোচনায় আসে।’