যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সিদ্ধান্ত একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
রোববার সচিবালয়ে তার দপ্তরে ব্রিফিংকালে তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত এ সিদ্ধান্তের গভীরে বাংলাদেশবিরোধী কিছু ব্যক্তি ও অপশক্তির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমাদের বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন তাদের এ অযৌক্তিক এবং একপেশে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে অব্যাহত অগ্রযাত্রা তা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না, তারা এ জনপদ নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে চায়।’
যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে বলেও এ সময় উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন দ্বিপক্ষীয় এবং অভিন্ন ইস্যুসহ বহুপক্ষীয় ইস্যুতে দুই দেশ নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করছে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছি বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের একটি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি তাদের এ নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশকে নিজেদের দাসত্বের রাজ্যে সমর্পিত হতে বাধ্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা বলে দেশের জনগণ মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাস উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশ আশা করে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও বেশি তথ্যনির্ভর এবং যত্নবান থাকবে।
যেকোনো ইস্যু এলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে সুরাহার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন তা না করে একপেশে কোনো সিদ্ধান্ত বন্ধুপ্রতিম কোনো দেশের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশ তার ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছে।
‘র্যাব একটি এলিট ফোর্স হিসেবে কাজ করছে, সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ দমনে এই বাহিনী অত্যন্ত পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়ে কাজ করছে,’ যোগ করেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, এ বাহিনীর কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় এ বাহিনীর অন্তত সাত সদস্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। কোনো অভিযোগ থাকলে বাহিনী নিজে কিংবা মন্ত্রণালয় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ঢালাওভাবে অভিযোগ এনে একটি বাহিনীর প্রধান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞা দেয়া অযৌক্তিক, মানবাধিকারের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্তই এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আজ মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে, আমরা তাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আগে পর্যবেক্ষণের অনুরোধ করছি। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। সেখানে দৃশ্যমান বর্ণবাদ বিরাজ করছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছিলেন।’
কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য এবং নিপীড়ন প্রশ্নে খোদ জাতিসংঘের উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, মেক্সিকো-ইউএসএ সীমান্তে কতজন মারা গেছে? যেখানে বন্দুক হামলায় প্রতি বছর লাখো মানুষ মারা যায়, নির্বাচনে হেরে যে দেশের ক্যাপিটাল হিল দখল করতে গিয়ে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা বিশ্ববাসী লক্ষ্য করেছে। বিশ্ববাসী দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্বরূপ ও তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতির বেহাল অবস্থা।
অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার কথা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বারবার উল্লেখ করেছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খোদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাধা দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, যাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন বিভিন্ন সিটিতে রাস্তায় নামে, তাদের অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো খুনি এখনও আমেরিকায় লুকিয়ে আছে, যুদ্ধাপরাধীরাও সে দেশে পালিয়ে আছেন জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর অব লেবার রবার্ট রেইচ এক টুইট বার্তায় বিশ্বকে জানিয়েছিলেন শুধু ২০২০ সালে সে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৯৮৪টি।
২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে ৬ হাজার ৬০০ জন। প্রতি বছর সেখানে প্রায় এক হাজার মানুষ বিনা বিচারে প্রাণ হারায়, যা বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় বলে জানান ওবায়দুল কাদের।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশে খাদ্যসংকটের সময় ১৯৭৪ সালে কিউবার কাছে পাট বিক্রির অজুহাতে খাদ্যবাহী জাহাজ মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল আমেরিকা। ৭১-এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে, তবুও বন্ধুত্বের প্রশ্নে স্পর্শকাতর এ বিষয়গুলোকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি বাংলাদেশ।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র অতীতে কাজে আসেনি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন শূন্য থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও।
‘প্যালেস্টাইনে ওয়াশিংটনের মিত্র দেশ ইসরায়েল যখন নির্বিচারে অবলা নারী, নিরপরাধ শিশুসহ শত শত ঘরবাড়ি ধ্বংস করে মিসাইল নিক্ষেপ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ইসরায়েলের পক্ষে থাকে, টু শব্দটাও উচ্চারণ করে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা মধ্যপ্রাচ্য, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানের মানুষের মৃত্যু এবং উদবাস্তু হওয়ার পেছনে দায়ী তারা আজকে বিশ্বকে মানবাধিকারের ছবক দিচ্ছে।’