বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পাহাড়ের ডাক ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব: নিশাত মজুমদার

  •    
  • ১১ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:০০

‘এবার পর্বত দিবসের স্লোগান ‘সাসটেইনেবল মাউন্টেইন ট্যুরিজম’। আমরা লেখা আহ্বান করেছি। পাহাড়ে যাওয়ার গল্প লেখার ভিত্তিতে আমরা পুরস্কার দেব। আমাদের দেশের পাহাড়ে ভ্রমণের সুযোগ পাবে বিজয়ীরা। আমরা ম্যারাথন দৌড়ের সঙ্গে যুক্ত। সেটাও থাকছে পর্বত দিবস উপলক্ষ্যে।’

পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে পর্বত দিবস। জাতিসংঘ ১১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ২০০৩ সালে। সেই থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিনটি পালিত হয়।

দেশের প্রথম নারী এভারেস্ট-জয়ী নিশাত মজুমদার নিউজবাংলাকে জানান, এবারের পর্বত দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সাসটেইনেবল মাউন্টেইন ট্যুরিজম’। করোনার কারণে অনেক কিছু থমকে গেছে বলে অনেক অনেক আনুষ্ঠানিকতা নেই বলেও জানান তিনি।

নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি দিবসটি ছাড়াও জানিয়েছেন পর্বতারোহণের নানা গল্প। এখানকার সমস্যা, সম্ভাবনা।

বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির মুহূর্তে তার অর্জনও স্বাধীন বাংলাদেশের সঞ্চয়। প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন এ পর্বতারোহী।

বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে, অর্থাৎ বিজয়ের ৫০ বছর। এর মধ্যে যেসব গৌরব, তার মধ্যে আপনার অর্জনও রয়েছে। তার অংশীদার আমরা সবাই। কেমন লাগে?

বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি আমাদের জন্য, বাংলাদেশিদের জন্য খুব অহংকারের একটি মুহূর্ত। এ সময়টা আমাদের অনেকভাবে উদযাপন করার কথা ছিল, পাহাড় নিয়ে অনেক কিছু করার কথা ছিল, অনেক কিছু যুক্ত করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোভিড আমাদের সবকিছু থমকে দিয়েছে।

তবে আমার পর্যবেক্ষণ থেকে যুক্ত করে বলতে চাই অহংকার অবশ্যই আবার রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কোথায় যাবার কথা ছিল, কোথায় গিয়েছি- এটার মূল্যায়ন করার সময়ও এখন। অনেক ক্ষেত্রে সামনে এগিয়েছি, অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি।

সম্প্রতি আপনি লবুচে পর্বতে আরোহণ করেছেন বলে ধারণা করছি। কারণ ফেসবুকে এ বিষয়ে আপনার পোস্ট দেখেছি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাই।

অতি সম্প্রতি, গত মাসের ২১ তারিখে ছিল আমাদের আরোহণের দিন। প্রতিবছরই চেষ্টা করি পাহাড়ে যাবার এবং আরোহণ করার। গত দুই বছর কিছুই করতে পারিনি। তাই কিছুটা সময় পেতেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি।

নেপালের হিমালয়ের একটি ছোট পাহাড় লবুচে। এভারেস্টের পাশেই এটি। যারা মাউন্ট এভারেস্টে যায়, তারা এই পাহাড়টা কেউ বেছে নেয় আরোহণ করার জন্য। এর উচ্চতা ৬ হাজার ৯০ মিটার।

দেশ-বিদেশের মোট কতটি পর্বত আরোহণ করেছেন আপনি?

গুনতে হবে। ১৫ থেকে ১৮টির মতো হবে। ১৮টি হবে।

দেশ-বিদেশের পর্বত আরোহণের পার্থক্য তো রয়েছে? সেগুলো কেমন?

দুটি বিষয়, একটি হলো মাউন্টেইন আরেকটি হিল। আমাদের দেশে যেগুলো সেগুলো সবই হিল। এটি উচ্চতার ওপর নির্ভর করে। মাউন্টেইনে যেতে চাইলে নেপাল বা ভারতে যেতে হয়। হোয়াইট মাউন্টেইন হলো টোতে বরফ পড়ে থাকে।

আমাদের দেশে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে কিছু হিল আছে, যেগুলো উচ্চতায় কম। সেখানে যাওয়া হয় কখনো কখনো প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে। নতুনদের নিয়ে যাই।

উচ্চতার পার্থক্যের কারণে পোশাকের পার্থক্য হয়, খাওয়াদাওয়ার পার্থক্য হয়। আমাদের এখানে তো গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়া যায়।

আমরা যারা গরমের দেশে থাকি বা সমতলের মানুষ, তাদের জন্য হোয়াইট মাউন্টেইন বা বরফের পাহাড় আরোহণ অনেক কষ্টের, খুবই চ্যালেঞ্জিং। পাহাড়ে উঠতে যত ওপরে উঠতে থাকি তত অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে। তখন হার্ট ও ফুসফুসের ওপর চাপ পড়তে থাকে।

আপনি তো প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। সেটা কি আগে থেকেই? নাকি আপনার এভারেস্ট আরোহণের পর থেকে?

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটি চাহিদা তৈরি হয়েছে। এটি আনন্দের বিষয় হয়ে উঠেছে। এভারেস্টে আরোহণ করার পর আমার দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। সেখান থেকে আমি প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি।

অনেক পর্বত আরোহণ করেছেন; একটা ভয় তো নিশ্চয়ই কাজ করে।

পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে থাকে ভয়, আতঙ্ক। প্রতি পদক্ষেপে মনে হয় যে এটিই সবচেয়ে ভালো সময় এখান থেকে ফিরে যাওয়ার। পরের সময়টায় জানি না আমি বেঁচে থাকব কি না।

আমার এটা হয়, আমি বাসা থেকে যখন বিদায় নিয়ে যাই, বাসায় তো আর বলা যায় না, মনে মনে বলি এটাই হয়তো শেষবিদায়। পাহাড়ের প্রতিটা মুহূর্তেই বিপদের আতঙ্ক।

এভারেস্টে আমি বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। অনেক সময় বোঝাও যায় না যে শরীরের সব শক্তি কীভাবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একদমই বলা যায় না, কখন চলে আসবে শেষমুহূর্ত।

পাহাড়ের একটা শিহরণ আছে। দূর থেকে দেখলেও সেই শিহরণটা পাওয়া যায়। পাহাড়ের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আমরা এটাকে বলি ‘মাউন্টেইন কলিং’। মাউন্টেইন একবার যদি ডাকে, সেটা ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব হয়ে যায়।

এভারেস্ট বাদ দিয়ে কোনো শিহরণ জাগানো গল্প যদি বলেন।

অনেক অনেক মুহূর্ত আছে। এ মুহূর্তে একটা মনে পড়ছে। আমি ককেশাস পর্বতমালায় গিয়েছিলাম, মাউন্ট এলবুর্জ, রাশিয়াতে, জর্জিয়ার শেষ সীমান্তে। যখন আমি সামিটের কাছাকাছি পৌঁছাই, তখন দেখি সেদিন পূর্ণিমা ছিল, পূর্ণিমার চাঁদটা অস্ত যাচ্ছে আর সূর্য উঠছে। এটি আমার কাছে মনে হয়, আমার এক মানবজীবনে এ রকম অভাবনীয় মুহূর্ত হয়তো আর পাব না।

এসবের জন্য মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজন কেমন?

প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা। পর্বতারোহণ খুবই ব্যয়বহুল একটি বিষয়। একটি ফুটবল হলে ২২ জন খেলতে পারে। ক্রিকেট ব্যাট আর বল হলেই অনেকে মিলে খেলতে পারে, কিন্তু পর্বতারোহণ একজনের জন্যই লাখ লাখ টাকা প্রয়োজন। এটার কাছেই আমরা বারবার হেরে যাচ্ছি।

আমি যেমন এইবার গেলাম। এখানে আমার একজন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে যেতে চেয়েছি এবং বিশেষ করে নারীকে। আমাদের কোনো পৃষ্ঠপোষক পেলাম না। পরে আমি আমার চেষ্টায় যেতে পারলেও কাউকে নিয়ে যেতে পারিনি।

এগুলো নিয়ে কখনও সরকারের কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে আপনার বা তারা কোনো আগ্রহ দেখিয়েছে?

আমি আসলে পাইনি।

বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকরা কি বিষয়টি ওয়াকিবহাল নাকি তাদের বিষয়টি ভালো করে বোঝাতে হয়?

তাদের ভালো ধারণা আছে। আমরা আসলে যে এই পর্যন্ত এসেছি সেটা কর্পোরেটের সাহায্যে। আমি যখন এভারেস্টে গিয়েছি তখন ১১টি প্রতিষ্ঠান ছিল আমার স্পন্সর। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে ওয়াকিবহাল।

আর কী কী সীমাবদ্ধতা দেখেন?

যারা পর্বত আরোহণ করবে, তাদের লাইফস্টাইল এবং মনোযোগ ঠিক থাকা দরকার। তরুণদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে মনে হয়।

এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে বা গ্লোবালাইজেশনের কারণে বিস্ময়টি কমে গেছে। আমার ব্যক্তিগত অনুধাবন হলো, কখনও কখনও আগ্রহ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে।

পাহাড় একটা মনঃসংযোগের বিষয়। পাহাড় একসেস দেয়, যে ঠিক আছ তুমি, আমার কাছে আসতে পার। এই জায়গাটার জন্য একটা পাহাড় এবং পর্বতারোহীর মধ্যে যোগাযোগ দরকার, যার জন্য প্রয়োজন মনঃসংযোগ।

এর জন্য একটা লাইফ স্টাইল লাগে। কখন, কীভাবে খাচ্ছি, কখন ঘুম থেকে উঠছি, সারা দিন আমি কী করছি, এমনকি কী ভাবছি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

কীভাবে আমি দড়িটা বাঁধব, কীভাবে হাঁটবো, কী খাব, আমি যখন বিপদে পড়ব তখন কী করব, কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয় যদি, তখন আমি কীভাবে নিজেকে বাঁচাব, এই কাজগুলো কিন্তু হাতে-কলমে শিক্ষা নিতে হয়। এটার জন্য আমাদের পাশের দেশে বিশেষ করে ভারতে যেতে হয়। এই প্রশিক্ষণ কিন্তু খুব ব্যয়বহুল, লম্বা একটা প্রশিক্ষণ। এই প্রোগ্রামে আমাদের কিছু নিজস্ব অর্থায়নে পাঠিয়েছি, কিন্তু ট্রেনিংয়ের পরবর্তী কাজ হলো পাহাড়ে যাওয়া। পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারছি না, তাই তরুণদের যাওয়া হচ্ছে না।

আপনারা যারা পর্বতারোহী, তাদের মধ্যে যোগাযোগ বা কোনো সংগঠন রয়েছে কি না?

আমরা একটা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারিনি, তবে আমাদের যোগাযোগ আছে।

আমি কিছু প্রস্তাব করেছি যে সরকারের যুব উন্নয়ন নিয়ে অনেক ফান্ড আছে। খেলাধুলায়, কালচারাল কাজে ফান্ড আছে। সেখানে থেকে অ্যাডভেঞ্চার ফান্ড করতে হবে। যেসব ছেলে-মেয়ে পর্বত আরোহণে যেতে চায়, সেখানে একটা সুবিধা পাবে। এটা ভারতে আছে।

এই অর্জন কখনও কি মূল্যহীন মনে হয়? হীনম্মন্যতায় ভোগেন?

আমি কখনও হীনম্মন্যতায় ভোগি না। আমি আমার দেশের মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছি, যে পরিমাণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি, একজীবনে আর কিছু পাওয়ার নেই।

খারাপ লাগা আছে, আমরা ২০১১ সাল থেকে পর্বত আরোহণ করে আসছি। ১০ বছর কেটে গেল, কোথায় আছি, কোথায় থাকার কথা ছিল। এটা একটা স্লো প্রোসেস, তারপরও।

১১ ডিসেম্বর পর্বত দিবস। আপনারা এটা পালক করেন কি না?

কভিডের কারণে কিছুই করা হচ্ছে না। এবার পর্বত দিবসের স্লোগান ‘সাসটেইনেবল মাউন্টেইন ট্যুরিজম’। আমরা লেখা আহ্বান করেছি। পাহাড়ে যাওয়ার গল্প লেখার ভিত্তিতে আমরা পুরস্কার দেব। আমাদের দেশের পাহাড়ে ভ্রমণের সুযোগ পাবে বিজয়ীরা। আমরা ম্যারাথন দৌড়ের সঙ্গে যুক্ত। সেটাও থাকছে পর্বত দিবস উপলক্ষ্যে।

শেষে আর কিছু বলতে চান?

আমার দুই ধরনের কাজ। একটি হচ্ছে নিজেকে পাহাড়ের সঙ্গে রাখা, আরেকটি হচ্ছে যারা পাহাড়ে যেতে চায়, তাদের পাহাড়ের কাছে নিয়ে যাওয়া। দুভাবেই কিছু পরিকল্পনা করেছি। বাকিটা নির্ভর করছে পৃষ্ঠপোষকতার ওপর।

আরেকটি জিনিস বলতে চাই। আমরা সবাই পাহাড়ে যাব, কিন্তু ওই পাহাড়ে যাওয়াটা যেন আমাদের দায়িত্বশীল ভ্রমণ হয়।

আমি যে জায়গায় যাব, সেই পরিবেশের কোনো ক্ষতি করব না বা সেখানকার মানুষের সম্মান করব। সেখানকার প্রাণ-প্রকৃতির যেন কোনো ক্ষতি না হয় আমার দ্বারা।

ওই জায়গাটার জন্য তো আমরা যাচ্ছি, ওটা যদি না থাকত তাহলে তো যেতাম না, ওইটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে যে মানুষটি বছরের-পর-বছর বাস করছে, সেই মানুষটি ওখানে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের শ্রদ্ধা করব, ভালোবাসব ও সম্মান করব। পর্বত দিবসে এটি আমার মিনতি আবেদন।

ছবি: নিশাত মজুমদারের ফেসবুক থেকে

এ বিভাগের আরো খবর