নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য ও ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পদত্যাগ করেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। দলের পদ থেকেও তাকে দেয়া হয়েছে অব্যাহতি।
মুরাদের পদত্যাগের পর তার এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, মুরাদ তার অনুসারীদের মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এ ছাড়া তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে খোদ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই বিব্রত ছিলেন। এ কারণে তার মন্ত্রিত্ব হারানোর পর উল্লসিত এলাকাবাসী।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, মুরাদের রাজনীতির শুরু বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের মাধ্যমে হলেও কিছু দিনের মধ্যে তিনি যোগ দেন ছাত্রলীগে। এরপর যুবলীগ করে হয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর পান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ।
দাম্ভিকতা আর অশালীন মন্তব্যের কারণে সব মহলেই সমালোচনার পাত্র ছিলেন তিনি। এ কারণে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানোর পর তাকে জামালপুর জেলার স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদও এখন তার নেই।
জামালপুরের স্থানীয়রা জানান, মুরাদের বাড়ি সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে। তবে তার পরিবার এখন থাকে জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার একটি বাসায়।
পদত্যাগের খবরে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে একজন আরেকজনকে মিষ্টিমুখ করান আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
মুরাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার। তিনি দীর্ঘদিন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন।
মুরাদের শিক্ষাজীবন ও ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামালপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৯০ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৯২ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের (মমেক) এম-৩০ ব্যাচে এমবিবিএসে ভর্তি হন।
তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। মেডিক্যালে ভর্তির পরই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন মুরাদ। ১৯৯৬ সালে কলেজ শাখা কমিটি দেয়া হলে প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ডিসেম্বরেই ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করে ছাত্রলীগে যোগ দেন মুরাদ। ১৯৯৭ সালে মমেক শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। ২০০০ সালে একই শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
মুরাদের সময় ছাত্রদলের মমেক শাখার সভাপতি ছিলেন সৈয়দ মেহবুব উল কাদির। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইসহাক।
ডা. মেহবুব উল কাদির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দলের হয়ে মিছিল-মিটিংয়ে মুরাদের সরব উপস্থিতিসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কমিটিতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে তার কার্যক্রম দেখে আমরা প্রচার সম্পাদকের পদ দিই।’
সদ্য বিদায়ী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান
মুরাদ হাসান যে কমিটিতে ছিলেন, সে কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন তখনকার জেলা ছাত্রদল সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুরাদ বরাবরই সুবিধাবাদী ছিলেন, দলের দুঃসময়ে তিনি পল্টি দেন। ক্ষমতার পালাবদলে নিজে ভোল পাল্টে ছাত্রদলের পদধারী নেতা থেকে হয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি। এ জন্য মুরাদকে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা হিসেবেই আমরা চিনতাম।’
তখনকার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম রিপন নিউজবাংলাকে জানান, মুরাদ ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসে ভর্তির পরই ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হন। পরে তিনি কলেজ শাখা ছাত্রদলের কমিটির প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুরাদের বাবা মতিউর রহমান তালুকদার ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরও ছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় পরে মুরাদকে ছাত্রলীগে পদ দেয়া হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, মুরাদ ২০০১ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ২০০৩ সালে তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। একই বছর আওয়ামী লীগের জামালপুর জেলা শাখার সদস্যও হন।
এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী, মেস্টা ও তিতপল্যা) আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৪ সালে সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ২০১৫ সালে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন মুরাদ। ২০১৭ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যকরী সদস্যও হন।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেলেও ২০১৮ সালে ফের নৌকা নিয়ে সংসদ সদস্য হন মুরাদ। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।
২০১৯ সালের ১৯ মে মন্ত্রিসভায় রদবদল আনা হলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থেকে মুরাদকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়।
সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদের অভিযোগ, মুরাদ তার বাবার কারণে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এমপি হয়েই তিনি দলের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি করেন। আধিপত্য বিস্তার করতে একটি ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেন।
ওই সময় তার ‘ক্যাডার বাহিনী’ সরিষাবাড়ীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার ক্যাডারদের হাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী লাঞ্ছিত হন। এ ছাড়া তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও মনগড়া মন্তব্যে বিব্রত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মুরাদের দ্রুত উত্থান হয়েছিল। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগে পদ পাওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর একের পর এক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে নিজের ব্যবহারের কারণে প্রকৃতিও তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মুরাদ এমপি হওয়ার পর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি। তার পাশে অনেক অবাঞ্ছিত কর্মীকে জায়গা দিয়েছেন। নিজেও সংযত না হওয়ার কারণেই আজ সব হারাতে বসেছেন তিনি।’
জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ বাকী বিল্লাহ বলেন, ‘একজন প্রতিমন্ত্রী তার পদ হারিয়েছেন, এমন খবরে নিজের নির্বাচনি এলাকার লোকজন ও কর্মীদের কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল, তবে মুরাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো দৃশ্য দেখেছি।
‘সাধারণ জনতাসহ নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন। এতেই বোঝা যায় মুরাদের জনপ্রিয়তা আর নেতার প্রতি কর্মীদের ভালোবাসা কতটা কম।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুরাদ আগে থেকেই বিতর্কিত ছিলেন। তার ছত্রছায়ায় থাকা কিছু নেতা-কর্মী তাকে আরও বিতর্কিত করেছেন। এ জন্য মুরাদের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীরা তার পাশে নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
গত ১ ডিসেম্বর এক ফেসবুক লাইভে মুরাদ হাসান খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক বক্তব্য দেন। বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এরপর চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার অশোভন কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হলে শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
এমন পরিস্থিতিতে মুরাদকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি সোমবার রাতে নিশ্চিত করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মুরাদ পরদিন পদত্যাগপত্র দিলে রাতেই সেটি গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি।