বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। সুনীল জলরাশি। বিস্তৃত বালুকাবেলা। প্রবাল পাথরের জলকেলি কিংবা উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড় নিয়ে যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার।
সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ এই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে অনেক গুণ। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে অনেক পিছিয়ে কক্সবাজার। এ জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকাকেই দায়ী করা হয়। এবার সেই দায় থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
কক্সবাজারকে আধুনিক, পরিকল্পিত ও পর্যটকবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা।
আগামী ৫ বছরের মধ্যে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মতো নান্দনিক রূপ দিতে চায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)।
সংস্থাটির আশা, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুধু দেশিই নয়, বিদেশি পর্যটকদের পদচারণে মুখর থকবে কক্সবাজার। এতে সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে রাজস্ব আয়ও।
কউকের চেয়ারম্যান ফোরকান আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৬ সালে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের পর থেকেই কক্সবাজারকে একটি আধুনিক-রুচিশীল পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীতায় সেভাবে এগোনো যায়নি। এখন সেই সমস্যা কাটিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু হয়েছে।’
ফোরকান আহমেদ বলেন, ‘কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতের ৭০.০৬ একর জায়গাকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করে সেটিকেই মহাপরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, যার গেজেটও হয়ে গেছে।
‘বিশাল এই সৈকতকে ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে আধুনিক করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। আর বাঁকখালী নদীর চার পাশ হাতিরঝিলের আাদলে তৈরি করা হবে। গড়ে তোলা হবে নতুন নতুন আধুনিক শহর।’
দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যাতে আনন্দময় সময় কাটাতে পারেন, সে জন্য উন্নত দেশের সৈকত এলাকায় যে যে সুবিধা আছে, তার সবই কক্সবাজারে রাখা হবে বলেও জানান কউক চেয়ারম্যান।
কউকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এ জন্য সরকারের কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে না; বরং আয় হবে। সরকার শুধু নিয়ন্ত্রণ করবে।’
পর্যটকদের নিরাপত্তা
এই মহাপরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হবে পর্যটকদের নিরাপত্তায়। তারা যাতে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টায় নির্বিঘ্নে সৈকত এলাকায় চলাফেরা করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য সব সময় তৎপর থাকবে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
বিদেশিদের জন্য থাকবে আলাদা জোন
বিদেশি পর্যটকদের জন্য কক্সবাজারে তৈরি হবে আলাদা দৃষ্টিনন্দন জোন। সেখানে থাকবে বিনোদনের সব ধরনের ব্যবস্থা। থাকবে আলাদা হোটেল-মোটেল সুবিধা। খোলা স্থানে থাকবে দেশি-বিদেশি শিল্পীদের কনসার্ট আয়োজনের ব্যবস্থা। রাখা হবে টেনিস-গলফ ও সার্ফিংয়ের ব্যবস্থা।
প্রশস্ত হবে সড়ক
পর্যটনবান্ধব নগরী গড়ে তুলতে কক্সবাজার শহরের সব রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। সৈকতের পাশ ঘেঁষে ঘিঞ্জি গলি বদলে গিয়ে হবে ৪ লেনের রাস্তা। প্রধান প্রধান সড়কের কোথাও ৪ আবার কোথাও হবে ৬ লেন। এ ছাড়া পর্যটকদের হেঁটে চলাফেরার জন্য থাকবে প্রশস্ত ফুটপাত।
সি অ্যাকোরিয়াম
সমুদ্রের তলদেশের রহস্যময় অপার সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে তৈরি করা হবে বিশালাকৃতির সি অ্যাকোরিয়াম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৈকতে এ ধরনের অ্যাকোরিয়াম থাকলেও বাংলাদেশে এর অভাব দীর্ঘদিনের।
পরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল স্থাপন
মহাপরিকল্পনায় কক্সবাজারের সব হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট পরিকল্পিতভাবে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। বন্ধ করা হবে যেখানে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ এবং হোটেল-মোটেল জোন এলাকায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে করা হবে সুইমিং পুল। এ ছাড়া অভিজ্ঞ পর্যটন গাইড ব্যবস্থাপনার জন্য গঠন করা হবে আলাদা ইউনিট।
বঙ্গবন্ধু থিম পার্ক
সৈকতের জলরাশিতেই পা ভিজিয়ে আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি শিশু, কিশোর, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষের বিনোদন জন্য তৈরি করা হবে বঙ্গবন্ধু থিম পার্ক। সাধারণ পার্কের সঙ্গে থিম পার্কের পার্থক্য হচ্ছে এটি একটি থিম বা বিষয়বস্তুর ওপর তৈরি করা হয়। সেই থিমকে কেন্দ্র করে এর স্থাপনা এবং রাইডগুলো সাজানো হয়।
আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক স্থাপন
শুধু থিম পার্কই নয়, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের শিশুপার্কও গড়ে তোলা হবে। সেখানে স্থানীয় শিশুদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টদের সন্তানরাও আনন্দ করতে পারবে। এ জন্য সুবিধামতো জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি আইকনিক ঘড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
আধুনিক জেটি ঘাট স্থাপন
কক্সবাজারের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, পিকনিক স্পট, বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতের জন্য আধুনিক জেটিঘাট নির্মাণ করা হবে, যাতে ঘাট ব্যবহার করে পর্যটকরা নৌপথে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া এলাকায় ভ্রমণ করতে পারেন।
সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক
শুধু কক্সবাজার শহরেই নয়, টেকনাফের সাবরাং এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে আরেকটি ট্যুরিজম পার্ক। কাজ শেষ হলে এখানে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০ হাজার পর্যটক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)
টেকনাফ সৈকতের পাড়ে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কটির আয়তন ১ হাজার ৪৭ একর। এখানে অভিজাত হোটেল-মোটেল তৈরি করবে কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক এলাকায় ঢুকতেই দেখা যায় মেরিন ড্রাইভের পাশেই প্রকল্পের নামফলক। সৈকত ঘেঁষে বেশ কিছু এলাকায় হয়েছে বালু ভরাট। নির্মাণ করা হয়েছে তিন তলা প্রশাসনিক ভবন। বসানো হয়েছে বৈদ্যুতিক পিলার।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের প্রকৌশলী আব্দুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা বেজার প্রকল্প হলেও বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকেই আমরাসহ মোট তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখানকার ভূমি, রাস্তা ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ পেয়েছি। এই অক্টোবরেই কাজ শুরু হয়েছে।
‘আমাদের প্রতিষ্ঠান এইচবিবি রোড তৈরি ও ভাঙন রোধের জন্য জিও ব্যাগের কাজ করছি। আর বালু ভরাটের কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠান।’
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টেকনাফের এই নীল পানিতে গা ভেজানোর আগ্রহ অনেক পর্যটকের। এতদিন সবাই কক্সবাজার ও ইনানী বিচেই যেতেন, কিন্তু সেখানকার পানি সাবরাংয়ের মতো নীল না। আশা করছি প্রকল্পটি হয়ে গেলে বিদেশি পর্যটকরাও এখানে আসবেন নীল জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।’
কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজার পর্যটন এলাকার উন্নয়ন নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সৈকত হওয়ার পরও এতদিন এটি অবহেলিত ছিল। সৈকত ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল-মোটেল। এগুলোর অবসান হওয়া দরকার।’
মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবেই আমরা যে ইকো সিস্টেম পেয়েছি, সেটা আমাদের ব্র্যান্ডিং। আমি চাই এই মহাপরিকল্পনা শুধু সৈকতকেন্দ্রিক নয়, পুরো কক্সবাজারেই হোক।’