চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল রোজার সময় চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মঘণ্টা কমানোসহ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শ্রমিকেরা। তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাত জনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন সংগঠন। হাইকোর্ট নিহতদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃশ্যত কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি এ নিয়ে।
গত বছর ১০ মার্চ সন্ধ্যায় রাজধানীর হাতিরপুলে ম্যাগাজিন পক্ষকাল-এর অফিস থেকে বের হওয়ার পর সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ হন। এ নিয়ে প্রথমে থানায় ডায়েরি ও পরে মামলা করে তার পরিবার।
ঢাকা থেকে নিখোঁজের ৫৩ দিন পর গত ২ মে রাতে যশোরের বেনাপোলের ভারতীয় সীমান্ত সাদিপুর থেকে নিজ দেশেই অনুপ্রবেশের দায়ে কাজলকে আটকের কথা জানায় বিজিবি। পরে নিখোঁজের আগের দিন এক সংসদ সদস্যের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাসহ অন্যান্য মামলায় প্রায় সাড়ে আট মাস কারাভোগের পর গত বছর ২৫ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পান কাজল।
ওই বছর কোনো গুম বা নিখোঁজের ঘটনা নজরে আসেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। এ নিয়ে তেমন কোনো তৎপরতাও চোখে পড়েনি তাদের। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনায় কমিশনের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হওয়ার কথা।
এসব ঘটনায় জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো সব সময় সোচ্চার থাকলেও এ ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা অনেকটাই নীরব।
এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও মানবাধিকার কমিশনের তৎপরতা চোখে পড়েনি।
সাধারণ মানুষ, মানবাধিকার কর্মীসহ বিশেজ্ঞরা বলছেন, যে আশা ও আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে এক দশক আগে মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে, তার প্রতিফলন কমিশনের কাজে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এতো দিনেও জনগণের ভরসা ও আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি স্বাধীন এ সংস্থাটি। কমিশন বরাবরই রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে শুক্রবার পালন হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন অনুযায়ী, সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা তাদের সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে এ কমিশন নিজ উদ্যোগে বা দরখাস্তের ভিত্তিতে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারবে। এ ব্যাপারে কমিশন কোনো সুপারিশ করলে তা বাস্তবায়ন করে ছয় মাসের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি
গত অক্টোবরে প্রকাশিত আইন ও শালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বছরের প্রথম নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ‘ক্রসফায়ারে’ ৪৮ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে ৬৭ জন মারা যান। এর মধ্যে কয়েদি ২৫ জন এবং হাজতি ৪২ জন।
একই সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৫৪ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সময় একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটজন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন এবং হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ১৩ সাংবাদিক আহত হন। এ ছাড়া ১০৬ সাংবাদিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা আছে এমন অধিকাংশ বিষয়ে কমিশন অতি সতর্কতা দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে কমিশন জানে না তার ক্ষমতা কতটুকু। আবার যতটুকু ক্ষমতা আছে, তা-ও তারা প্রয়োগ করে না। কমিশন একটি সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ছোট কিছু ঘটনা ছাড়া তাদের সুপারিশের যথাযথ বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রম
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মানবাধিকার কমিশন বলছে, বিভিন্ন ঘাটনায় তারা তাৎক্ষণিত তৎপরতা দেখিয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকটি ঘটনায় প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সরকারের কাছে সুপারিশ দিয়েছে।
জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাদের বিভিন্ন কর্মতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এবারের প্রতিপাদ্যও বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও। কমিশনও সে নীতিতে বিশ্বাস করে, সেভাবেই কাজ করে। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, সেখানেই কমিশন ভূমিকা রাখে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে মানবাধিকারের প্রশ্নে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, সে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। তা ছাড়া আবরার হত্যার বিচারের রায়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে মানবাধিকার নিয়ে যে সংশয় ছিল, তা কেটেছে বলেও মনে করি।’
কমিশন বলছে, গত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কমিশনে ১ হাজার ৩৪৯টি অভিযোগ পড়েছে। এর মধ্যে কমিশন ৬৫ শতাংশ বা ৮৭২টির নিষ্পত্তি করেছে।
এর আগে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৩৭টি অভিযোগ পড়ে। এর মধ্যে ৫ হাজার ২৫৬টি নিষ্পত্তি হয়। তবে এ সব অভিযোগের বেশিরভাগই ব্যক্তি কেন্দ্রিক।
এ দিকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ‘উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘মানবাধিকারের দুটি দিক: একটি রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, আরেকটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে ততটা হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আইনের শাসন যতটা দৃঢ় হওয়ার কথা ছিল, মজবুত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানবাধিকারের প্রশ্নে অনেক কাজ করার রয়েছে। তবে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠান বা মানবাধকার কামিশনকে। কিন্তু এ কমিশন যে গতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে, তা ধরে রাখতে পেরেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। অনেকটাই মৃয়মান হয়ে গেছে। তার যে সম্ভাবনা ছিল, তার সুর হারিয়ে ফেলেছে, মাথা নত করে ফেলেছে।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘কমিশনকে আমলাদের একটা পুনর্বাসন স্থল করে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টেরও একটা রায় আছে। তাই স্বাধীনচেতা কিছু মানুষ যদি এর পরিচালনার ভারে না থাকে, তা হলে এ কমিশন থেকে বেশি কিছু হবে না।
‘কমিশনের কাজ তো মানবাধিকার রক্ষা করে সরকারকে সাহায্য করা। রাষ্ট্রের যেসব সংস্থা বা ব্যক্তি ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তাদের বিরুদ্ধে নিরীহ জনগণের পাশে দাঁড়ানোই মানবাধিকার কমিশনের কাজ।’