বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সংক্রান্ত এক্সপোজার লিমিট গণনা পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসার পর সূচকের পর দিনই ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই পক্ষকে নিয়ে বসবেন- এমন একটি খবর প্রকাশ হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হওয়ার পর বেড়েছে বেশিরভাগ শেয়ারের দর।
আগের দিন ৯৬ পয়েন্ট পতনের স্মৃতি নিয়ে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার সকালে লেনদেন শুরুই হয় সূচক বেড়ে। আধা ঘণ্টার মধ্যে সূচক বেড়ে যায় ৭৪ পয়েন্ট। কিন্তু পরে সেখান থেকে কিছুটা কমে ৩২ পয়েন্ট যোগ করে শেষ হয় লেনদেন।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৮৪ পয়েন্ট। বেড়েছে ২১৪টি কোম্পানির শেয়ারদর, কমেছে ১০৬টির। অপরিবর্তিত ছিল ৫৭টির দর।
গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি, আইসিবি ও এনবিআরকে নিয়ে বৈঠক শেষে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়নি। জানানো হয়, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট ক্রয়মূল্য নাকি বাজারমূল্যে হবে, বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না, এসব বিষয়ে আরও একটি বৈঠক করতে হবে। সেটি চলতি মাস বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে। সেই বৈঠকের পর দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।
তবে এই বৈঠকের ফলাফলে হতাশ হয় বিনিয়োগকারীরা। বুধবার বড় দরপতন ঘটে পুঁজিবাজারে। এক দিনেই দর হারায় ২৫৭টি কোম্পানি।
লেনদেন শেষে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ আসে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে নিয়ে বৈঠক করবেন। তার আগে সরকার প্রধান আলাদা বসবেন গভর্নরের সঙ্গে।
এই বৈঠকের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসেনি কোনো পক্ষ থেকে। নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসি প্রধান বলেন, ‘বিষয়টি খুবই গোপনীয়’।
শেষ সময়ে কিছুটা কমলেও দিনভর সূচক বেড়েই লেনদেন হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে
বৈঠক ডাকার এই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মনে যে চিড় ধরা আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে পেরেছে, সেটি সপ্তাহের শেষ দিনের লেনদেনেই স্পষ্ট।
তবে এখনও বিনিয়োগকারীরা নতুন করে লেনদেনে না গিয়ে পরিস্থিতি যে পর্যবেক্ষণে রাখছেন, সেটিও বোঝা যায়। লেনদেন কোনো রকমে এক হাজার কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে।
বেশ কয়েক মাস পর লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে বস্ত্র খাত। গত দুই সপ্তাহ ধরে শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যাংক খাত নেমে এসেছে দ্বিতীয় অবস্থানে। তৃতীয় অবস্থানে ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাত।
এই তিনটি খাতেই লেনদেন হয়েছে একশ কোটি টাকার বেশি। আগের দিন চার খাতে এবং তারও আগের দিন পাঁচটি খাতে লেনদেন ছিল শত কোটি টাকার বেশি।
শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, স্বল্প মূলধনি ও লোকসানি কোম্পানির দাপট ফিরে এসেছে। গত জুলাই থেকে এই ধরনের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর ক্রমেই কমছিল। গত তিন দিন ধরে আবার দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
খাতওয়ারি বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শেয়ারের দর বেড়েছে বস্ত্র, বিবিধ খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। প্রকৌশল, সিমেন্ট, ওষুধ ও রসায়ন খাতেও দিনটি খারাপ যায়নি।
অন্যদিকে ব্যাংক, আর্থিক, বিমা খাতে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর। এর মধ্যে ব্যাংকে দর বৃদ্ধির হারও বেশি নয়, যেগুলোর দর কমেছে, সেগুলোও খুব বেশি দর হারায়নি।
বৃহস্পতিবার সূচক বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকায় ছিল এই ১০টি কোম্পানি
সূচক বাড়ায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো। কোম্পানিটির ১.৪৭ শতাংশ দর বৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ৭.৬৪ পয়েন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ওয়ালটনের দর ১.২৪ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৬.৬১ শতাংশ।
বিকন ফার্মা, আইসিবি, রেকিড বেনকিনজার, লিনডে বিডি, স্কয়ার ফার্মা ইউনিলিভার, ইউনাইটেড পাওয়ার ও ব্র্যাক ব্যাংকের দর বাড়ার কারণেও সূচকে পয়েন্ট যোগ হয়েছে।
এই ১০টি কোম্পানির দর বৃদ্ধিতেই সূচকে যোগ হয়েছে ২৬.৩৩ পয়েন্ট।
অন্যদিকে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, গ্রামীণ ফোন, ডেল্টালাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেক্সিমকো ফার্মা, তিতাস গ্যাস, ওরিয়ন ফার্মা, জিপিএইচ ইস্পাত, সোনালী পেপার, ইস্টার্ন ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের দরপতনের কারণে সূচক থেকে পয়েন্ট কমেছে সবচেয়ে বেশি।
তবে দরপতনের হার খুব বেশি না হওয়ায় সূচক কমেছেও কম। ১০টি কোম্পানি মিলিয়ে সূচক ফেলেছে ৬.২১ পয়েন্ট।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক নিচের দিকে টেনে ধরতে প্রধান ভূমিকায় ছিল
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে স্বল্প মূলধনি-দুর্বল কোম্পানির প্রাধান্য
পর পর তিন দিন এই বিষয়টি দেখা গেল। গত জুন থেকেই এই ধরনের কোম্পানিগুলো ক্রমাগত দরপতনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই কয়েক মাসে কোনো কোনো কোম্পানি ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে।
দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল ওটিসি ফেরত তমিজ উদ্দিন টেক্সটাইল। শেয়ার দর বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। শেয়ার দর ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫৪ টাকা।
বিবিধি খাতের দুর্বল কোম্পানি এসকে ট্রিমসের শেয়ারদর গত ছয় মাসে তার সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি দর হারিয়েছিল। ৬২ টাকা থেকে ২৫ টাকায় নামার পর গত ২৮ নভেম্বর থেকেই আবার ঊর্ধ্বগামী যাত্রা শুরু হয়।
এই কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৯.৮৩ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। বাড়ার সুযোগ ছিল ৩ টাকা। বেড়েছেও ততটাই। দিন শেষে দাম দাঁড়িয়েছে ৩৩ টাকা ৫০ পয়সা।
নয় শতাংশ শেয়ার দর বেড়েছে আরও একটি কোম্পানির। সেটি ছিল সায়হাম টেক্সটাইল। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৮০ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ারদর গত তিন মাসে বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল। আগের দিন দর ছিল ২০ টাকা ৪০ পয়সা। এক দিনেই বেড়েছে ২ টাকা।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা স্বল্প মূলধনি জেমিনি নি ফুডের দর বেড়েছে ৮.৭৩ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার দর ২৬১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮৩ টাকা ৮০ পয়সা।
আরেক স্বল্প মূলধনি এএমসিএল (প্রাণ) শেয়ার দর বেড়েছে ৮.৫৯ শতাংশ। এক সপ্তাহ ধরেই কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ৬ খাত
৭ শতাংশের বেশি শেয়ার দর বেড়েছে পাঁচটি কোম্পানির। এর মধ্যে স্বল্প মুলধনি লিবরা ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৭.৪৯ শতাংশ, লোকসানি সোনারগাঁও টেক্সটাইলের দর বেড়েছে ৭.২২ শতাংশ, আরেক লোকসানি স্বল্প মূলধনি অনালিমা ইয়ার্নের দর বেড়েছে ৭.০৩ শতাংশ। স্বল্প মূলধনি বিডি ল্যাম্পসের দর বেড়েছে ৭.০৩ শতাংশ।
গত কয়েক মাসে ব্যাপক হারে মূল্য সংশোধন হওয়া এমএল ডাইংয়ের দর বেড়েছে ৭.২২ শতাংশ।
শীর্ষ দশের বাইরে ছয় শতাংশের বেশি শেয়ার দর বৃদ্ধি পাওয়া চারটি কোম্পানির মধ্যে লোকসানি বিচ হ্যাচারির দর ৬.৬৪ শতাংশ, আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দর ৬.৫৭ শতাংশ, দুই স্বল্প মূলধনি রংপুর ফাউন্ড্রির ৬.৩৫ শতাংশ ও মুন্নু এএমজেএলের দর বেড়েছে ৬.০৫ শতাংশ।
আরও আটটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ১৭টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১৬টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৩০টির দর ২ শতাংশের বেশি, ৬০টির দর ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
দর পতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি ৫.৫৮ শতাংশ কমেছে সুহিৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের দর। গত কয়েক দিন টানা উত্থান হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার মূল্য ১৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১৮ টাকা ৬০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ডমিনোজ স্টিলের দর ৫.৩০ শতাংশ কমে ২৮ টাকা ৩০ পয়সা থেকে হয়েছে ২৬ টাকা ৮০ পয়সা।
ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ার দর ৪.৮৭ শতাংশ, অ্যাপোলো ইস্পাতের দর কমেছে ৪.৬৭ শতাংশ কমেছে। ফু ওয়াং সিরামিকের শেয়ার দর ১৯ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৪.৫৯ শতাংশ কমে হয়েছে ১৮ টাকা ৭০ পয়সা। ফু ওয়াং ফুডের দর ৪.৩৯ কমেছে।
নতুন তালিকাভুক্ত সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দর হারিয়েছে। ৩.৮৬ শাতংশ কমে ৮২ টাকা ২০ পয়সার শেয়ার দিন শেষে হয়েছে ৭৯ টাকা ৫০ পয়সা।
অলেম্পিক একসেসোরিজের দর ৩.৮১ শতাংশ হারিয়ে ১৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে হয়েছে ১২ টাকা ৬০ পয়সা।
এ ছাড়া দুই শতাংশের বেশি শেয়ার দর কমা কোম্পানি ছিল আটটি। আরও ৩০টি কোম্পানির দর কমেছে ১ শতাংশের বেশি।
লেনদেনে এগিয়ে থাকা ১০ কোম্পানি
আগের বেশ কয়েকটিদের মতো এদিনও লেনদেনে এগিয়ে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। মোট লেনদেন হয়েছে ৭৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। মোট হাতবদল হয়েছে ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ১৯৭টি।
প্রধান খাতগুলোর মধ্যে বেশিরভাগের শেয়ারদর বেড়েছে
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জিএসপি ফাইন্যান্সে লেনদেন হয়েছে ৪০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে মোট ১ কোটি ৪৬ লাখ ৬৯ হাজার ৬৯৪টি।
জেনেক্স ইনফোসিসে লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ২ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে ১৬ লাখ ৩২ হাজার ৯৭৬ টি শেয়ার।
ডেল্টা লাইফে লেনদেন হয়েছে ১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে ৯ লাখ ৫৬ হাজার ১০টি শেয়ার।
ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোতে লেনদেন হয়েছে ১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। হাতবদল হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৪২৯টি শোর।
ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১ কোটি ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৮১৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যার বাজার মূল্য ছিল ১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
সাফকো স্পিনিংয়ে লেনদেন হয়েছে ১৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আরও ১৪টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি।
১০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে চারটি ছিল ব্যাংক খাতের। এগুলো হচ্ছে ওয়ান ব্যাংক, যার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকার।
আইএফআইসি ব্যাংকের ১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকার, ব্র্যাক ব্যাংকের ১১ কোটি ৯২ লাখ টাকার এবং এনআরবিসি ব্যাংকের ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
নয় কোটি টাকার বেশি লেনদেন হওয়া তিনটি কোম্পানির মধ্যে দুটি ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতের স্কয়ার ফার্মা ও ফার্মা এইড। একটি ছিল ট্যানারি খাতের ফরচুন সুজ।