ভারত মহাসাগরের সুনীল পানিবেষ্টিত দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। প্রায় ১২০০ ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির মূল আয়ের খাত পর্যটন। মূলত পানিকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে দেশটির পর্যটন।
বাংলাদেশকে বলা হয় নদীর দেশ। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত। আছে অপার সৌন্দর্যের অসংখ্য হাওর। পানির এত সমাবেশের পরেও দেশে পানিকেন্দ্রিক পর্যটন সেভাবে বিকশিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে মালদ্বীপ এগিয়ে আছে কয়েক যোজন।
মালদ্বীপের স্থানীয়দের মধ্যে পর্যটন সচেতনতার কারণে দেশটিতে অপরাধের মাত্রাও অনেক কম। পর্যটকদের জন্য বলতে গেলে সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি দেশে পরিণত হয়েছে মালদ্বীপ।
দেশটির রাজধানী মালেসংলগ্ন দ্বীপশহর হুলুমালের নিরোলহু মাগু এলাকার গেস্ট হাউস ড্রিম রিল্যাক্স ইন-এ কাজ করেন বাংলাদেশি কর্মী রাসেল মিয়া। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে এক আমেরিকান আমাদের এখানে এসেছিলেন। তিনি ফেরার সময় ভুল করে একটি ব্যাগ ফেলে যান। পরের বছর তিনি যখন আবার এখানে অতিথি হয়ে এলেন, সেই ব্যাগ তিনি একই অবস্থায় ফেরত পেয়েছেন। এ ধরনের বিষয়গুলোই এ দেশের পর্যটনকে বিদেশিদের কাছে নিরাপদ করে তুলেছে।’
মালদ্বীপের সড়কগুলো ঝকঝকে তকতকে। সমুদ্রসৈকতে ময়লা, আবর্জনা দেখা যায় না। বাতাসে নেই কোনো ধুলাবালি। এর বাইরে সমুদ্রের নীল পানির সৌন্দর্য তো আছেই।
বাংলাদেশের মোংলার পশুর নদীতে যেমন ডলফিনের অভয়ারণ্য রয়েছে, একইভাবে হুলুমালের অদূরেই ভারত মহাসাগরে ডলফিনের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে মালদ্বীপ। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে ডলফিন দেখতে যান হাজারো পর্যটক।
এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাওয়ার যোগাযোগব্যবস্থাও বেশ ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পর্যটক ও স্থানীয়রা নৌকা, স্পিডবোট কিংবা ইয়টে চলাচল করেন। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য সি প্লেন। কিছুক্ষণ পরপরই সেগুলো পর্যটকদের নিয়ে যায় এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে।
মালদ্বীপ কেন প্রতি বছর লাখো পর্যটককে টানছে- জানতে চাইলে স্থানীয় এক গাইড ইয়ান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রকৃতি। প্রকৃতিই মালদ্বীপের একমাত্র সম্পদ। আপনি পৃথিবীর কোথাও এত সুন্দর ও স্বচ্ছ পানির সমুদ্র দেখতে পাবেন না।
‘এখানে সাধারণত ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ান পর্যটকেরা বেশি আসেন। এ ছাড়া বহু আমেরিকান ও চীনা পর্যটকও আসেন। তারা বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি রিসোর্টে চলে যান। অনেকে স্থানীয় দ্বীপগুলোতেও থাকেন। এখানে তারা সমুদ্র দেখার পাশাপাশি স্কুবা ডাইভিং বা সি সার্ফিংও করেন। অনেকে আসেন পরিবার নিয়ে নিভৃতে ছুটি কাটাতে।’
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওর-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট। এসব কারণে পানিভিত্তিক পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম মনে করছেন, মালদ্বীপের পর্যটনের সঙ্গে বাংলাদেশের পর্যটনের কোনো তুলনাই চলে না।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মালদ্বীপের ধারেকাছেও নেই। একসময় মালদ্বীপের মানুষের মূল আয় ছিল মাছ ধরা। সেখান থেকে তারা আজ কোন পর্যায়ে এসেছে সেটা দৃশ্যমান। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করে তারা নিজেদের পর্যটন অবকাঠামো তৈরি করেছে। বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে তারা এ পর্যায়ে এসেছে।
‘তাদের সঙ্গে আমাদের একটি বড় মিল রয়েছে, দুই দেশই মুসলিম অধ্যুষিত। তবে এই ধর্ম পরিচয় তাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি। তারা রক্ষণশীলতা পাশে রেখেই পর্যটনকে এগিয়ে নিয়েছে। তাদের পর্যটন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এখন ৯৫ ভাগ। যারা বিনিয়োগ করেছে তারাই এর প্রচার করছে। সরকার কখনোই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা পুরো বিষয়টি পেশাদারদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।’
মালদ্বীপের সৈকতগুলোতে নেই ময়লা-আবর্জনাবাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আমরা মুখে পর্যটনের উন্নয়নের কথা বলি, কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা পর্যটনকে এগোতে দিচ্ছে না।
‘অবশ্য এখন টেকনাফের সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন যেটি হচ্ছে, এ রকম জোনভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে। এগুলো আরও আগে করা উচিত ছিল। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে তারও একটি সুফল পাওয়া যাবে। তবে সামগ্রিকভাবে পর্যটন খাত এগিয়ে নিতে সদিচ্ছা লাগবে, সমন্বয় লাগবে। এটি না হলে দেশের পর্যটন কখনোই এগোবে না।’
বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক কম আসার কারণ হিসেবে প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন ট্যুর অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি এবং বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সদস্য মো. রাফেউজ্জামান। এরপরেও মালদ্বীপের চেয়ে বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকেই এগিয়ে রাখছেন তিনি।
রাফেউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মালদ্বীপে মূলত এককেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেটি সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন। আমাদের এখানে কিন্তু পর্যটনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ রয়েছে। আমাদের এখানে যেমন সমুদ্র রয়েছে, একই সঙ্গে সুন্দরবন আছে, পাহাড় আছে আবার হাওর-বাঁওড়ও আছে।
‘আমাদের এখানে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বছরে প্রায় এক কোটি, এটা মালদ্বীপ কিংবা নেপালে চিন্তাই করা যায় না। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনা করলে ভারতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। একটি দিক দিয়ে তারা (মালদ্বীপ) এগিয়ে আছে, সেটি হলো বিদেশি পর্যটক। এর কারণ হলো বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ড সেখানে আইল্যান্ড রিসোর্ট পরিচালনা করছে। আর আমাদের দিক থেকে প্রচার সেভাবে করা হয় না।’
রাফেউজ্জামান অবশ্য মনে করছেন আগামী ১০ বছরে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। টোয়াব সভাপতি বলেন, ‘আমাদের এখানে এখন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে, এটা কিন্তু একটি অগ্রগতি। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০। এর মধ্যেই আশা করি, বছরে ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসতে পারব।
‘কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা চারটি পয়েন্ট দিয়ে পর্যটক রিসিভ করতে পারব। এগুলো হয়ে গেলে দেখবেন আমাদের দেশের পর্যটনের চিত্রই পাল্টে যাবে। হাওড়-বাঁওড়কেন্দ্রিক পর্যটনও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এগুলো হয়ে গেলে আমাদের পর্যটন আরও এগোবে।’
মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মালদ্বীপের মোট বিদেশি আয়ের ৭০ ভাগ আসে পর্যটন থেকে। এখানের পর্যটনের মূল আকর্ষণ হলো বিভিন্ন রিসোর্ট আইল্যান্ড। একটি দ্বীপ একটি রিসোর্ট- তারা এই নীতিতেই চলে। ২০১৯ সালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা মালদ্বীপকে সেরা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
‘একটি বিষয় খেয়াল করবেন, মালদ্বীপ শত ভাগ মুসলিম একটি দেশ। এখানে স্থানীয় অধিবাসীরা যেসব দ্বীপে বাস করেন সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোতে তারা বেশ সচেতন। এরপরেও তারা ধর্মীয় শ্রদ্ধার জায়গাটিকে অটুট রেখেই পর্যটন খাতকে উন্নত করেছে। রিসোর্ট আইল্যান্ডগুলোতে আপনি বিনোদনের জন্য সব করতে পারেন, কিন্তু স্থানীয় দ্বীপগুলোতে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। এ জন্য এখানে লাখ লাখ পর্যটক আসছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বসেরা যত হোটেল রিসোর্ট ব্র্যান্ড আছে, তাদের প্রত্যেকেরই রিসোর্ট এখানে আছে। প্রত্যেকটি রিসোর্টেই নিজেদের মতো করে পর্যটন ব্যবস্থাপনা রাখার অধিকার রয়েছে। সেখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না। মাঝে মাঝে এগুলোতে কর্মকর্তারা সারপ্রাইজ ভিজিটে যান। অনিয়ম পেলে প্রথমে সতর্ক করা হয়, পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এটাই মালদ্বীপের পর্যটন শিল্প বিকাশের মূল কারণ।
‘আমরা এখানকার পর্যটন অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডকে জানিয়েছি। এই অভিজ্ঞতা যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে আমাদের পর্যটনও উন্নত হবে। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি পর্যটক এখানে আসেন না। তবে সম্প্রতি ইউএস বাংলা যেহেতু সরাসরি ফ্লাইট শুরু করেছে, আশা করা যায় অনেক বাংলাদেশিই এখানে আসতে চাইবেন।’