এবার কাঁঠালের কোয়া (পাল্প) থেকে উন্নতমানের ও পুষ্টিকর দই, চকলেট, আইসক্রিম ও পনির তৈরির উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা।
এর আগে বিজ্ঞানীরা কাঁঠাল দিয়ে চিপস্, আচার, জ্যাম, জেলিসহ প্রায় ২০টি পণ্যের উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ‘পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রসেসিং অ্যান্ড মার্কেটিং অব জ্যাকফ্রুট’ প্রকল্পের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ।
বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্পের প্রধান গবেষক গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটির ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের চার ছাত্র এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তাকে সহায়তা করেন।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, স্বল্প মূলধন বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা এসব পণ্য নিয়ে কাজ করলে খুব সহজে লাভবান হতে পারবেন। একই সঙ্গে সারা বছরই এ পণ্য তৈরি করা যাবে।
বিজ্ঞানীদের এই উদ্ভাবন এরই মধ্যে তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও সাড়া ফেলেছে। এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে অনেক উদ্যোক্তাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।
শুধু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাই নয়, বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানি করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত মোট কাঁঠালের ৪৩ থেকে ৪৫ ভাগ শুধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। দেশের জাতীয় ফলের এ অপচয় রোধ করতে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন হাতে নেয় পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রসেসিং অ্যান্ড মার্কেটিং অব জ্যাকফ্রুট নামে একটি গবেষণা প্রকল্প।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করতে থাকেন কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের নানা উপকরণ ও প্রযুক্তি। যাতে উদ্যোক্তারা সারা বছরই বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে কাঁঠালকে ব্যবহার করতে পারেন।
গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা কাঁচা ও পাকা কাঁঠালের যেসব প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উদ্ভাবন করেছেন তা দেশের বড় বড় সুপার শপে বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে।
বিজ্ঞানী গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় এ বছর আমরা দই, পুষ্টিকর আইসক্রিম, চকলেট এবং পনির তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি। উদ্যোক্তারা যদি কাঁঠালের পাল্প সংরক্ষণ করেন, তবে সারা বছরই এসব পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘কাঁঠাল যেহেতু নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি ফল, কাজেই পাল্প দিয়ে তৈরি করা পণ্যও সাধারণ বাজারের পণ্য থেকে অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে। এতে কৃত্রিম রং বা ফ্লেভার ব্যবহার করা হয় না। পণ্যগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, দেখতেও সুন্দর।
‘দই তৈরিতে শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ পাল্প ব্যবহার করা হয়। আইসক্রিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ৫ থেকে ৮ ভাগ পাল্প। আর পনিরে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পাল্প ব্যবহার করতে হয়। এতে ক্ষুধা নিবারণ ও পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হবে। তৈরিকৃত খাদ্যগুলো থেকে প্রচুর ক্যালরি পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও জানান, যে কেউ স্বল্প টাকা বিনিয়োগ করে এগুলো তৈরি করতে পারবেন। একটি ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর বা ছোটখাটো কিছু হোম মেড যন্ত্রপাতি দিয়েই এসব পণ্য খুব সহজে তৈরি করা যাবে।
যদি কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ৮০০ টাকার কাঁচামাল ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি খুব সহজেই ১৫০০ টাকার পণ্য তৈরি করতে পারবেন। অর্থাৎ বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ করতে পারবেন। আর দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যাপক পরিসরে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব পণ্য তৈরি করলে দেশে এসব পণ্যের বড় বাজার তৈরি হবে। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, কাঁচা কাঁঠাল খেতে দারুণ সুস্বাদু। অথচ এটি ঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ অনেকেই জানেন না। গ্রাহক পর্যায়ে কাঁচা কাঁঠাল সারা বছর যেন পৌঁছে দেওয়া যায় সে জন্য আমরা কাজ করছি।
নিজের উদ্ভাবনের কথা বলতে গিয়ে ড. ফেরদৌস জানান, পাকা কাঁঠাল থেকে পাল্প সংগ্রহ করে সহজেই সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়, এ চিন্তা থেকেই দই, আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেয়া। আসে সফলতাও।
চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের চার ছাত্র সমীক কর প্রান্ত, আবির হাসান রিজন, অভিক চাকমা ও আসম রাফসান জানি তাদের অ্যাকাডেমিক কোর্স শেষে ট্রেনিং করতে এলে তাদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর কাঁঠালের উৎপাদন হয়, কাজেই তারা যদি এসব প্রযুক্তি ওই এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেখান থেকেও কাঁঠালচাষি, উদ্যোক্তা বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
বারির পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান কৃষিবিদ মো. হাফিজুল হক খান বলেন, ‘আমরা যদি এ সেক্টরে প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরি করতে পারি, তাহলে এর ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হবে যা কাঁঠালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতেও বড় অবদান রাখবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।’