বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১৭ বছরে দুদক কতটা সফল

  •    
  • ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ১০:০৪

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চুনোপুঁটি নিয়েই দুদক নাড়াচাড়া করছে। রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে দুদক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর দুদক বলছে, তাদের একেকজন অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে একই সঙ্গে ৩০টির মতো তদন্ত পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হয়। এ কারণে দক্ষভাবে এটি কাজ করতে পারে না। তাছাড়া আইনের ভেতরে থেকে তাদের কাজ করতে হয়। ফলে প্রক্রিয়াগত কারণেও গতি ধীর হয়।

দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিলুপ্ত করে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন এই সংস্থাকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশ্যা ছিল আকাশচুম্বী। ১৭ বছর পরে এসে বেশির ভাগ লোকই মনে করে, বড় ও প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের ধরতে এই সংস্থা সফল নয়। এ কারণে রাষ্ট্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনায় এটির ভূমিকা তেমন একটা নেই।

কমিশন বলছে, তাদের একেকজন অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে একই সঙ্গে ৩০টির মতো তদন্ত পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে দক্ষভাবে এটি কাজ করতে পারছে না।

দুর্নীতির বিষয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদকের ভূমিকা শুরু থেকেই বিতর্কিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদিও সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোককে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করেছে, কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে, তবে শুধু চুনোপুঁটি নিয়েই দুদক নাড়াচাড়া করছে। রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে সম্প্রতি দুদক খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, তা বলা যাবে না।

সামর্থ্য অনুসারে দুদকের কাছ থেকে আমরা কিছুই পাইনি, তা-ও বলা যাবে না। তবে যেটুক সামর্থ্য ও সক্ষমতা ছিল, তার পর্যাপ্ত ব্যবহার হয়নি। এ ছাড়া এই দীর্ঘ সময়ে মাঝেমধ্যেই দুদকের নেতৃত্বে দৃঢ়চেতার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যে ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, দুদক অনেক ক্ষেত্রেই তা পারেনি।’

তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক মনে করেন, আগের তুলনায় দুদক অনেক দক্ষতা অর্জন করেছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। কিছু কিছু কার্যক্রম দুদক সাফল্যের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, যা মানুষের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়েছে। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে দুদক আগের তুলনায় অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে।

অন্যদিকে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান সংস্থাটির সাফল্যকে অনেক বড় করে দেখেন। তিনি বলেন, ‘দুদক গত ১৭ বছরে যা করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে একটি নতুন ইমেজ তৈরি হয়েছে। আগে অনেকেই দুদককে নখদন্তহীন ব্যাঘ্র বলত। তবে দুদকের সে অবস্থা আর নেই। এখন আর কেউ সে কথা বলেনও না।’

দুদকের এই কমিশনার বলেন, ‘যারা দুর্নীতিবাজ, তাদের দমন করা অত সহজ না। এদের পেছনে অনেক লোক। আমাদের আইনের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। আমরা তো বিচার করি না। আমরা বিচার করার লোক না। আমরা পুলিশও না। আমাদের কাজ করতে হয় ধনী মানুষ নিয়ে। সেখানে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি আছে। রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে।’

নিজেদের সামর্থ্যের ঘাটতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দুদকে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে নিয়োজিত আছেন প্রায় ২০০ কর্মকর্তা। এতে একজন কর্মকর্তার ওপর প্রায় ৩০টি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে। আইনে দেয়া সময় অনুসারে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে কর্মকর্তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমান কমিশন জনবল ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে।’

দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান জানান, সরকারি অন্য সংস্থার সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এতে কমিশনের কর্মপরিবেশ নষ্ট হয়। বর্তমান ভবন ভেঙে সেখানে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণ করলে আগামী দিনে কাজে দেবে। এ ছাড়া ফরেনসিক ল্যাব তৈরির বিষয়েও কমিশন কাজ করছে। বর্তমানে কমিশনের মামলায় সাজার হার প্রায় ৭০ ভাগ। শতভাগ সাজার হার করতে এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের।

তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে দুর্নীতি পুরোপুরি নির্মূল করতে হয়তো আমরা পারব না। তবে দুর্নীতি দমনের প্রশ্নে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছি এবং আগামী দিনে থাকব।’

জনবল ও পরিধি বাড়ছে

চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুদকে ৩ হাজার ৮৭৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। একই সময়ে ১ হাজার ৫২১টি মামলা তদন্তাধীন। কমিশনের মোট জনবল ১ হাজার ৮২ জন। এর মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ২০০ কর্মকর্তা।

সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়া হয়েছে তিন বছর আগে। চলমান ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ১৪টি সমন্বিত জেলা অফিস। প্রতিটি অফিসের অধীনে থাকছে একাধিক জেলা।

সহকারী পরিচালক ও উপসহকারী পরিচালক পদে আরও ২৮০ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। দুই বছরের মধ্যে বর্তমান জনবলকে দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা আছে কমিশনের।

গোয়েন্দা তৎপরতা ও আড়ি পাতা

২০১৮ সালে দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয় গোয়েন্দা ইউনিট। এ পর্যন্ত ৫৫০টি অভিযোগ গোপনে অনুসন্ধান করেছে তারা। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্ধশতাধিক সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গোপনে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ হচ্ছে।

একজন পরিচালকের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলা কার্যালয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে এর কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত ১৪২টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে।

দুর্নীতিবাজদের ফোনে আড়ি পাতার সক্ষমতাও দুদকের আছে। তবে এটি সচরাচর করা হয় না। খুবই অল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠিত রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের ধরতে ফোনে আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

তদন্ত কর্মকর্তাদের গাছাড়া ভাব

দুদকের তদন্তে ধীরগতিতে সম্প্রতি হতাশা প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম মনে করেন, মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই বেশি দায়ী। কারণ কমিশন তদন্তকারী কর্মকর্তা (উপসহকারী পরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক) ও তদারককারী কর্মকর্তাদের (উপপরিচালক, পরিচালক, মহাপরিচালক) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।

দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান জানান, এখন পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এটার জন্য একটা গবেষণা শুরু করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘নানা কারণে অনুসন্ধান ও তদন্ত সময়োত্তীর্ণ হতে পারে। আমরা ব্যুরোর আমলের মামলাগুলো এখনও তদন্ত করছি।’

কমিশন আইনের ২০(ক) ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নতুন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে কমিশন।

২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার ৭ বিধিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসংগত কারণ উল্লেখ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন।

আইনে বলা আছে, দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই।

টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুদকের সামর্থ্য ও সক্ষমতার তুলনায় দেশে দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ-সংক্রান্ত মামলা অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠানটির আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া দুদক থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয় যে, দুদকের কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে একশ্রেণির দুদক কর্মকর্তা সেটাকে সুযোগ হিসেবে দেখেন এবং তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ছাড় দেন। দু-একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। দুদকের কর্মকর্তা যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বেন, তাদের জন্য দুর্নীতির কারণে যে ধরনের শাস্তি দেয়া হয়, তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কমিশন এ বিষয়টি অনুধাবন করা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’

এ বিভাগের আরো খবর