রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামের সোহরাব হোসেনের (ছদ্মনাম) কিশোরী মেয়ের বিয়ে হয় সপ্তাহ দুই আগে। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। পরিবারের সদস্যরা অনেকটা তোড়জোড় করে বিয়ে দেন তার। তাই বর্তমানে কখনও বিদ্যালয়ে, কখনও স্বামীর বাড়িতে আসা-যাওয়া করছে সে।
বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা এ দেশে অপরিচিত কোনো ঘটনা নয়। তবে এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামের জন্য। কারণ এ গ্রামেই জন্ম বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার।
সারাজীবন নারী মুক্তির জন্য কাজ করা বেগম রোকেয়া বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধেও ছিলেন সরব। তবে তার মৃত্যুর ৮৯ বছর পরও নিজ গ্রামেই হচ্ছে বাল্যবিয়ে।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সারা দেশে পালিত হচ্ছে রোকেয়া দিবস।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামে জন্ম নেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যু হয় তার। দিনটিকে পালন করা হয় রোকেয়া দিবস হিসেবে।
এদিকে বেগম রোকেয়ার ৮৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেও পায়রাবন্দে বাল্যবিয়ে বন্ধ না হওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রোকেয়া অনুরাগীরা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাল্যবিয়ের কারণে এ গ্রামের অনেক ছাত্রীই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। অধিকাংশের পড়াশোনার গণ্ডি শেষ হচ্ছে মাধ্যমিকেই।
গত কয়েক দিনে পায়রাবন্দ ঘুরে পাওয়া গেছে একই তথ্য। স্থানীয়রা নিউজবাংলাকে জানান, পায়রাবন্দে এখনও চলছে বাল্যবিয়ে। প্রকাশ্যে এসব বিয়ে না হলেও গোপনে চলছেই। রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ এই ইউনিয়নকে এখনও বাল্যবিয়ে মুক্ত করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।
পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকী বলেন, ‘যিনি (বেগম রোকেয়া) নারীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার জন্য এত কিছু করলেন, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন অথচ আমাদের অনেক বান্ধবী বিবাহিত। হয়তো কারও অমতে, আবার কারও ফ্যামিলির চাপে বিয়ে হচ্ছে।’
বাল্যবিয়ের শিকার একাধিক কিশোরী জানায়, বিয়েতে মত না থাকলেও পরিবারের চাপে তাদের বিয়ে করতে হয়েছে। করোনার মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বিয়ের চাপ বেশি ছিল। এখন ক্লাসও করে আবার স্বামীর বাড়িতেও যায় তারা।
পায়রাবন্দ বাজার এলাকার মহসিন আলী বলেন, ‘আগোত দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছোটোতে নাতি-নাতনিদের বিয়ে ঠিক করি থুইচে। কইচে মুই কোন দিন বে-মরি যাং বিয়েটা দিয়ে যাং...। এমন করি কয়া কয়া বিয়ে হইচে।
‘এ্যালাও হয়, কিন্তু আগের মতোন আর বিয়ে নাই। এ্যালা মানুষ শিক্ষিত হওচে, সচেতন হওচে, সেই জন্যে কমি গেইচে।’
মোখলেছুর রহমান নামের আরেকজন জানান, আগের মতো এখন বড় অনুষ্ঠান করে বাল্যবিয়ে হয় না। হঠাৎ তারা জানতে পারেন একজনের ছেলের সঙ্গে আরেকজনের মেয়ের সম্পর্ক। তখন তাদের কিছু করার থাকে না। তবে আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয় না।
পায়রাবন্দ ইউনিয়নের কাজী আনছারুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক বছরে কমপক্ষে ৩০টি বাল্যবিয়ের রেজিস্ট্রি না করে ফেরত এসেছি আমি, কারণ তাদের বয়স হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে শুনি তাদের বিয়ে হয়েছে। কে বিয়ে পড়াইছে, আর কে রেজিস্ট্রি করাইছে, কিছুই জানিনে। খালি শুনি বিয়ে হইছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন তো ডিজিটাল যুগ, কত দুই নম্বরি করি বিয়ে পড়াচ্ছে অনেকে। অনেক সময় ধরার কিছু থাকে না। অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।’
করোনার সময় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং পরিবারগুলোর আর্থিক দুরবস্থাকে বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পায়রাবন্দের অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাঈদা পারভীন বলেন, ‘আমি ইন্ডিকেট করে বলতে পারব না যে, কোন বাচ্চাটার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু প্রধান শিক্ষক হওয়ার কারণে সংবাদ আসে যে দু-চারজনের বিয়ে হয়ে গেছে।
‘আমরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের এবং বাইরে অভিভাবকদের মোটিভেশন সব সময় দিই, যাতে বাল্যবিয়ে না হয়। কিন্তু একেবারেই বন্ধ হচ্ছে না। স্কুল খোলা থাকলে হয়তো এতটা হতো না।’
বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জানা মতে, আমার বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রীর গোপনে বিয়ে হয়েছে। এসব বিয়ে রংপুরে হয় না। রংপুর বা পায়রাবন্দের বাইরে অন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে হয়।
‘আমরা যখন জানতে পারি, তখন বলার বা করার কিছু থাকে না। আগের তুলনায় বাল্যবিয়ে কমেছে। তবে এখনও বন্ধ হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়জার রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখনও বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পারিনি। প্রতিনিয়ত এ নিয়ে কাজ করছি।
‘এমনকি উপজেলার সব ইমাম, মুয়াজ্জিন, বিবাহ রেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করেছি। আমরা কাজ করছি। আশা করছি ফল পাব।’
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন, ‘তিনি যে (বেগম রোকেয়া) মানসিক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেখান থেকে নারী সমাজ বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না সেটাই মূল কথা। আমাদের তার চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে আসছি বটে, তবে আরও সচেতন হতে হবে।’
রোকেয়া দিবসে নানা আয়োজন জেলা প্রশাসনের
বেগম রোকেয়ার ১৪১তম জন্ম ও ৮৯তম মৃত্যু দিবসে নানা কর্মসূচি নিয়েছে রংপুর জেলা প্রশাসন।
এর মধ্যে রয়েছে বেলা ১১টায় বেগম রোকেয়া স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দিবস উদ্বোধন, বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভা, দুপুর সাড়ে ১২টায় নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে রোধ সম্পর্কিত সেমিনার, পুরস্কার ও পদক বিতরণ আর দুপুর ১টায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। বিকেল সাড়ে ৩টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হবে দিবসের আয়োজন।