মালদ্বীপের রাজধানী মালের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত একমাত্র দ্বীপ হুলুমালে। দ্বীপটির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বা যেকোনো দোকানে পণ্যের দাম জানতে গিয়ে যদি কানে বাংলা ভেসে আসে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুধু হুলুমালে নয়, মালেসহ মালদ্বীপের যেকোনো দ্বীপেই দেখা মিলবে বাংলাদেশি কর্মীদের।
দেশটির অবকাঠামো, পর্যটন, মৎস্যশিল্পসহ সব খাতেই কাজ করছেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্য বলছে, দেশটিতে কাজ করা বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক লাখ। অথচ সরকারি হিসাবে দেশটির জনসংখ্যাই হলো পাঁচ লাখ। অর্থাৎ দেশটিতে প্রতি পাঁচজনে একজন বাংলাদেশি বাস করছেন।
মালদ্বীপে কাজ করা বাংলাদেশিদের অভিযোগ, দেশটিতে পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ তৈরি হলেও বাংলাদেশ সরকার শ্রমবাজার সম্প্রসারণে যথেষ্ট তৎপর নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশি কর্মীদের মজুরি বাড়াতেও তৎপর নয় বাংলাদেশ দূতাবাস।
হুলুমালের নিরোলহু মাগু এলাকার গেস্ট হাউস সি এরিনার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন কুমিল্লার মো. রিয়াদ। তিনি জানান, প্রায় চার বছর ধরে দেশটিতে আছেন তিনি।
মালদ্বীপে কাজের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে রিয়াদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানকার মানুষ খুব ভালো মানসিকতার। মধ্যপ্রাচ্যের মতো এখানে বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় কম। এখানে প্রচুর বাংলাদেশি কাজ করছেন, সামনে আরও কাজের সুযোগ বাড়বে। ‘কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, মালদ্বীপ অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি দেশ। সে হিসেবে কর্মীরা যে বেতন পান তা অত্যন্ত কম।’
বাংলাদেশিদের গড় বেতন কত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিরা এখানে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ডলার করে পান। পাশাপাশি থাকা ও খাওয়ার জন্য সামান্য ভাতা। এ কারণে একটি ঘরে অনেককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।’
হুলুমালের একই এলাকার বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিনের অভিজ্ঞতাও একই। তিনি মালদ্বীপে আছেন প্রায় ১২ বছর।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অন্য দেশ থেকে যারা আসেন যেমন ভারত বা শ্রীলঙ্কা, তাদের বেতনের বিষয়টি ওই দেশগুলোর দূতাবাস আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাস কোনো উদ্যোগ নিলে আমরা আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম। এ বিষয়টিতে আমাদের সরকারের নজর দেয়া উচিত।’
মালদ্বীপে প্রবাসীরা কীভাবে থাকেন তা কিছুটা আন্দাজ করা যায় নিরোলহু মাগুর দোকান কর্মচারী আফতাবের কথা থেকে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশিরা এখানে মূলত গেস্টহাউসগুলোতে থাকেন। একটি কক্ষে দেখা যায় ১২ থেকে ১৬ জন পর্যন্ত থাকেন।
‘আমি যেখানে থাকি, সেখানে এক কক্ষে ১৬ জন আছেন। মাস শেষে আমাদের ভাড়া আসে প্রায় ৫০ হাজার রুপিয়া (এক রুপিয়া সমান ৫ টাকা)। এটিই এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
ভারত মহাসাগরের নীল পানিবেষ্টিত ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। প্রায় ১২০০ ছোট-বড় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এ দেশ। স্থলভাগ মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার আর সমুদ্রসীমা ধরলে আয়তন প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার।
দেশটিতে সাধারণত দুই ধরনের দ্বীপ দেখা যায়। এর মধ্যে এক ধরনের দ্বীপকে বলা হয় লোকাল আইল্যান্ড, যেখানে স্থানীয়রা বসবাস করেন। আর পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত দ্বীপগুলো রিসোর্ট আইল্যান্ড নামে পরিচিত। দুই ধরনের দ্বীপেই আছেন বাংলাদেশি কর্মীরা।
দেশটিতে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে আরও কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়ে কাজ করছেন তারা।
মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মালদ্বীপে সব মিলিয়ে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এদের মধ্যে ৫০ হাজারই এখন অনিয়মিত। তারা এখানে কাজ করলেও ওয়ার্ক পারমিট নেই।
‘অন্য দিকে ২০১৯ সালে মালদ্বীপ সরকার একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি ছিল তারা এক বছর বাংলাদেশ থেকে কোনো কর্মী নেবে না। এক বছর পার হয়ে গেলে এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা, তবে আমরা জানতে পারছি, তারা নতুন করে বাংলাদেশ থেকে কাউকে এখানে ওয়ার্ক পারমিট দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে দেশটির সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা কথা বলছি। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও তুলেছিলেন।’
বাংলাদেশের হাইকমিশনার বলেন, ‘শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের কথা রয়েছে। সফরের সূচি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এটি হয়তো দুই-এক মাসের মধ্যেই হবে। সেই সফরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যখন নানা ইস্যুতে কথা উঠবে, এটি নিয়েও কথা হবে। শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক থেকে একটি সুখবর আসবে বলে আমরা আশা করছি।’
মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে যে বাংলাদেশিরা আছেন তারা দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এটা মালদ্বীপ সরকারও স্বীকার করে। তাদের অবকাঠামো, ফিসিং, পর্যটনসহ সব খাতেই বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করছেন।
‘অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা এখানে যেসব কাজ করেন, সেটা অন্য দেশের কর্মীরা করতে চান না। মালদ্বীপে সামনে অবকাঠামো খাতে অনেক প্রকল্প শুরু হবে। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মীদের বিকল্প নেই। কোভিডের পর এখন নতুন করে মালদ্বীপের পর্যটন খাত খুলতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রেও তাদের অনেক বিদেশি কর্মী লাগবে, যার ভালো জোগান আসতে পারে বাংলাদেশ থেকে।’